কামাল পাশা

রেজাউল করিম

| বুধবার , ২৬ মে, ২০২১ at ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

কাজী নজরুল ইসলাম দ্রোহের কবি। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী বাংলাদেশের এই জাতীয় কবি। সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর বিচরণ অবাধ। তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। কাব্য রচনায় তাঁর অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নজরুল সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সামপ্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এজন্য ইংরেজ সরকার তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে এবং তাঁকে কারাদণ্ড দেয়।
১৯২১ সাল। বিদ্রোহী কবির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যবাহী। তাঁর কিছু রচনা ও ঘটনা শতবর্ষ পার করছে। এ সময়ই তিনি অমর সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করেন। ‘বিদ্রোহী’র শুরুতেই কবি বলছেন- ‘বল বীর/ বল উন্নত মম শির!’ নতজানু না হওয়ার অনমনীয় দৃঢ়তার নামই নজরুল। লিখেন ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার’ প্রভৃতি। ‘ভাঙার গান’ও এ সময়কার সৃষ্টি। ঐ বছরের নভেম্বরে নজরুল আবার কুমিল্লা যান। ২১ নভেম্বর ভারতব্যাপী হরতাল ছিল। তিনি পথে নামেন এবং অসহযোগ মিছিলের সঙ্গে শহর প্রদক্ষিণ করে গাইলেন- ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী।’ এ সময় তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতে খেলাফত আন্দোলন চলছিল। অসহযোগ আর খেলাফত আন্দোলনের দর্শনে নজরুল আস্থাশীল ছিলেন না। স্বদেশে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বরাজ বা স্বাধীনতা অর্জন আর মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদকারী নব্য তুর্কি আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমর্থন ছিল। তবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে তিনি যুক্ত হন।
১৯২১ সালের শেষদিকে নজরুল তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’ রচনা করেন, যার মাধ্যমে তাঁর সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনা এবং ভারতীয় মুসলমানদের খেলাফত আন্দোলনের অসারতার পরিচয় পাওয়া যায়। নজরুল তাঁর রাষ্ট্রীয় ধ্যান-ধারণায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্ব দ্বারা, কারণ তুরস্ককে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। কামাল আতাতুর্ক ছিলেন নজরুলের নায়ক। কামাল তুরস্কের ভেতরে ও বাইরের শত্রুদের মোকাবেলায় যে সাহস, বুদ্ধিমত্তা এবং বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা নজরুলকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। ‘কামাল পাশা’ কবিতায় নজরুলের যে উল্লাস তা আর কোনো কবিতায় নেই। ‘ঐ ক্ষেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই/ অসুর-পুরে শোর উঠেছে জোর্সে সামাল সামাল তাই/ কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই!/ হো হো কামাল! তু নে কামাল কিয়া ভাই! লেফট্রাইট লেফট্‌!! লেফট্রাইট লেফট!! সাব্বাস ভাই! সাব্বাস দিই, সাব্বাস তোর শমশেরে।/ পাঠিয়ে দিলি দুশ্মনে সব যমঘর একদম-সে রে!/ বল্‌ দেখি ভাই, বল হাঁরে,/ দুনিয়ায় কে ডর করে না তুর্কির তেজ তলোয়ার?’ কবিতায় তিনি বাংলার সঙ্গে বিভিন্ন শব্দেরও ব্যবহার করেছেন, এই কবিতার ছন্দ উঠে এসেছে সৈনিকের কুচকাওয়াজ থেকে, যা একজন সৈনিক কবির পক্ষেই সম্ভব। তিনি ভেবেছিলেন, তুরস্কে যা সম্ভব, তা এখানেও সম্ভব। রুশ বিপ্লবও তাঁকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল। লাঙল ও গণবাণী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘সাম্যবাদী’ ও ‘সর্বহারা’ কবিতাগুচ্ছ এবং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ ‘জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত’ এবং ‘রেড ফ্লাগ’ অবলম্বনে রক্তপতাকার গান এর প্রমাণ।
স্বাধীনচেতা নজরুল। স্বাধীনতার জন্য কঠিন সাধনা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। আর যিনি নিজে স্বাধীন নন, তার পক্ষে অন্যকে কিংবা জাতিকে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। শৃঙ্খল জীবন তাঁর কাম্য নয়। গেয়েছেন সাম্যের গান। যুগে যুগে তিনি আমাদের মুক্তির প্রেরণা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসীমিত আকারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার অনুরোধ সুজনের
পরবর্তী নিবন্ধবাসের ধাক্কায় প্রাণ গেল কলেজছাত্রের