কাঁচাঘর

জুয়েল আশরাফ | শুক্রবার , ১১ জুলাই, ২০২৫ at ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ

গাঁয়ের নাম চরনালুয়া। পদ্মার চরে ভাঙাগড়া ঘরবাড়ি, শালুক ফুলের মতো ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা জীবন। এই গাঁয়ে থাকে জাফর মিয়া। বয়স পঁয়ত্রিশ। দেখতে রোগাপাতলা, মুখে মিশুক হাসি আর চোখে একটা টানা দৃষ্টি। যেন সবসময় কিছু খুঁজে বেড়ায়।

লোকজন কয়, ‘জাফর ভালো মানুষ,কিন্তু অস্থির। আজ যাইতেছে গোপালগঞ্জ, কাল কই হইব কে জানে!’

জাফর হাসে। বলে, ‘আমি খুঁজি একখান ঘর। ঠিকঠাক ঘর।’

এই ঘর খোঁজার পেছনে আছে একটা গল্প। দশ বছর আগে, পদ্মায় ভাঙনে সব হারাইছে জাফর। জমি, ঘর, ফজরের আজান শোনা মায়ের কবরসব। তখন থেকেই সে ঘর খোঁজে। কেবল বাঁশটিনের ঘর না, মনকে জড়িয়ে রাখে এমন এক ঘর।

একদিন সন্ধ্যার পর, গাঁয়ের ব্রিজের নিচে একদল কিশোরের গোল হয়ে বসা দেখে জাফর। কেউ বিড়ি টানতেছে, কেউ গাল দিচ্ছে। জাফর কাছে যায়, ‘এইসব করছ ক্যা রে?’

একজন বলে, “তারে কও না ভাই। স্কুলে যাইলে মাস্টার কয় ঘরের ঠিকানা কি? ঠিকানা থাকলে স্কুলে নেয়, না থাকলে কয় ‘ভবঘুরে’।”

জাফর চুপ করে। তারপর কয়, ‘ঠিকানা না থাকলে কি মানুষ নাই রে?’

তারপর সেদিন থেকেই, বাঁশ কিনে, কুড়ানো টিন জোগাড় করে। গাছের ছাল দিয়ে দড়ি বানিয়ে, জাফর বানানো শুরু করে একটা ঘর। ‘ভবঘুরে ঠিকানা ঘর’। একটা ঘর, যেইখানে কোনো ঠিকানা লাগে না। যেইখানে নাম লাগে না, শুধু লাগে একটা মন।

লোকজন শুরুতে হাসে। কেউ কয়, ‘তুই আবার মাদ্রাসা হবি?’

জাফর উত্তর দেয় না, খালি কাজ করে। একদিন, এক মেয়ের মা আসে। মেয়েটার নাম সুরাইয়া, বয়স চৌদ্দ, চোখে ভয় আর প্রশ্ন।

ভাইজান, আমার মাইয়ারে আপনার ওই ঘরে পড়াইবেন? তারে গাছতলায় রাখবেন?’

জাফর কয়, ‘আপা, আমি ইটের ঘর বানাইতে পারি না, কিন্তু ওর জন্য আসমানের নিচে একটু জায়গা রাখতে পারি।’

সেই থেকে সন্ধ্যায় ‘ভবঘুরে ঠিকানা ঘর’এ শুরু হয় লেখাপড়া। চরনালুয়া গাঁয়ে এই প্রথম মেয়েছেলে একসাথে বই পড়ে। লোকজন ধীরে ধীরে বদলায়। কেউ বই দেয়, কেউ খাতা। কেউ কয়, ‘আমার বড় ছাওয়ালকেও দ্যাশে ফিরামু, ও খালি শহরের ডাস্টবিন ঘাটানের কাম করে।’

একদিন এক সরকারি লোক আসে, দেখে, শুনে, তারপর মাথা নাড়ে। আপনারা নিয়ম ভাঙছেন। একে স্কুল বলা যায় না। অনুমোদন নাই, সনদ নাই।’

জাফর তার চোখে চোখ রেখে কয়, ‘আমরা নিয়ম বানাই নাই, আমরা নিয়মে আটকে নাই। এইখানে শুধু পড়া হয় না, এইখানে মানুষ বানানো হয়।’

সেই রাতেই কইরা ফেলে, ঘরের একপাশে আগুন লাগে। হয়ত বাতাস, না হয় কেউপরে জানা যায় ব্রিজের নিচের ছেলেরা সবাই দৌড়ায়, নিজের হাতে আগুন নেভায়। সুরাইয়া তার ওড়না ছিঁড়ে পানির পাত্র বেঁধে দেয়, এক পোলাপান ছাতা ধরে দাঁড়ায়, যাতে বই ভিজে না যায়। ভোরবেলা, জাফর বসে থাকে ধোঁয়া ওঠা কাঠের সামনে। তারপর বলে, ‘ঘর পুড়েছে। কিন্তু মন পোড়ে নাই। মন থাকলে ঘর আবার হবে।’

আর সত্যিই, এক মাসের মধ্যে চরের লোকজন নিজের হাতে নতুন করে ঘর বানায়। বাঁশ, টিন, পাটকাঠি, টালিসবার কিছু কিছু যোগ হয়। এইবার ঘরের সামনে কাঠের ফলক ঝোলে– ‘ঘর মানে শুধু চার দেয়াল নাঘর মানে যত্ন, বিশ্বাস, ভালোবাসা।’

এখন কেউ আর জাফররে ভবঘুরে কয় না। এখন চরনালুয়ার চরের মানুষ কয়, ‘ঘরের মানুষ হইতে সময় লাগে, কিন্তু জাফরের ঘরে ঢুকলে মানুষ হওয়া শেখা যায়।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রান্ত পলাশের কবিতা
পরবর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত, পাহাড় ধসের শঙ্কা