‘এফভি ড্রিম সী’ নামের কাঠের তৈরি ফিশিং ট্রলারটি ২০০০ সালের প্রথম দিকে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ‘ট্রায়াল’ পাসের মাধ্যমে বঙ্গোসাগরে মাছ শিকার করতো। ২০০৩-০৪ সাল পর্যন্ত মাছ শিকারের সাময়িক অনুমোদনও ছিল ট্রলারটির। কিন্তু পরে সেটি দুর্ঘটনায় পড়ে। এরপর থেকে কর্ণফুলী নদীর সদরঘাটে নোঙর করা অবস্থায় পচে নষ্ট হয় এটি। গত দুই মাস আগে আদালতের একটি আদেশ দেখিয়ে ‘এফভি ড্রিম সী’ প্রতিস্থাপনের জন্য চট্টগ্রাম নৌ-বাণিজ্য দপ্তরে জাহাজটি সার্ভের আবেদন করে। এরপর চট্টগ্রাম নৌ-বাণিজ্য দপ্তরে তোলপাড় শুরু হয়। চট্টগ্রাম থেকে সার্ভে করাতে ব্যর্থ হয়ে নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের খুলনার আঞ্চলিক অফিসে নতুন করে সার্ভের আরেকটি আবেদন করে। কিন্তু দালিলিক জটিলতা ও মিথ্যা তথ্য থাকার কারণ দেখিয়ে নৌ-বাণিজ্য দপ্তর খুলনা আঞ্চলিক অফিস থেকে সার্ভের আবেদনটি প্রত্যাখান করা হয়। চট্টগ্রামে আবেদন করার পর পুনরায় খুলনায় কিভাবে আবেদন করার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে চট্টগ্রাম নৌ-বাণিজ্য দপ্তর।
অভিযোগ রয়েছে, বঙ্গোসাগরে ব্লু ইকোনমির বড় অংশ হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ। সামুদ্রিক মাছকে কুক্ষিগত করতে নৌ-বাণিজ্যে বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এসব সিন্ডিকেট নষ্ট ও পচে যাওয়া ট্রলারের পুরোনো কিছু কাগজপত্র কিনে নতুন ফিশিং জাহাজ প্রতিস্থাপনের আবেদন করে। সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর ও নৌ-বাণিজ্য দপ্তরে ব্যর্থ হলে তারা আদালতের দ্বারস্ত হয়। এরপর নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সার্ভে করিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ আকারে ফিটনেস সনদ জারিসহ মাছ শিকারের অনুমতি হাতিয়ে নেয় সিন্ডিকেটটি।
‘এফভি ড্রিম সী’ নামের জাহাজটির বিষয়ে জানতে চাইলে সামুদ্রিক মৎস্য অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক (সামুদ্রিক) মো. শরীফ উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে জানান, ‘এফভি ড্রিম সী’ নামের একটি ট্রলার ট্রায়াল বেসিসে আমাদের এখানে ছিল। স্থায়ী কোনো লাইসেন্স ছিল না। কিন্তু দীর্ঘদিন এটি ফিশিংয়ে (মাছ শিকারে) নেই। জনৈক জহির আহমেদ সর্বশেষ ২০০৩-২০০৪ সাল পর্যন্ত এটির অনুমতি নিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘এই ফিশিং জাহাজের গ্রজ ওয়েট (মাছ ও বরফ বোঝাইসহ সর্বোচ্চ ওজন) ৪২ দশমিক ৯০ টন। এটি স্টিল বডি হওয়ার কথা হয়। গত ১৭ বছর ধরে ট্রলারটির হদিস নেই।’
সমুদ্রে চলাচলের জন্য অনুমতি দেওয়ার একমাত্র অভিভাবক প্রতিষ্ঠান নৌ-বাণিজ্য দপ্তর। নৌ-মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে। নৌ-বাণিজ্য দপ্তর চট্টগ্রামের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ গতকাল বুধবার দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘গত এপ্রিল মাসে এফভি ড্রিম সী নামের জাহাজটি সার্ভের জন্য আবেদন করেছে। সার্ভের আবেদনের ফাইলে আমি লিখেছি, নথি পর্যালোচনা করে উপস্থাপন করুন। আমাদের সার্ভেয়াররা নথিটি পর্যালোচনা করে দেখতে পান, ২০০২ সালে আদালতের একটি অর্ডার তারা ২০২০ সালে ফটোকপি নিয়েছে, আমাদের কাছে ২০২১ সালে উপস্থাপন করেছে। তাছাড়া আদালতের বার্তাবাহক ছাড়া কোনো আদেশ আসলে তাতো আমরা গ্রহণ করব না। হাতে হাতে কিংবা কোনো ফটোকপি আদেশতো গ্রহণযোগ্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘এরপর জাহাজটি সার্ভে করার জন্য আমি সার্ভেয়ারকে পাঠাইনি। এখন শুনেছি খুলনাতে এটি সার্ভে করার চেষ্টা হয়েছে। এখানে আমার কোনো অনুমতি নেই। হয়তো আমার অনুমতি ছাড়া কোনো সার্ভেয়ার গিয়েছে। কিন্তু আমার পূর্বানুমতি ব্যতিরেখে কোনো জাহাজ সার্ভেও বৈধ নয়। খুলনার বিষয়টি শুনার পর আমি খুলনায় পদায়িত আমাদের সার্ভেয়ারকে ফোন করেছি, উনি বলেছেন, ‘স্যার আমি জাহাজটি দেখতে গিয়েছি, সার্ভে করিনি।’
নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের এই প্রধান কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, ২০০২ সালে ট্রলারটি ছিল কাঠ বডি। দ্বিতীয়ত বর্তমানে সার্ভের আবেদনের সময় এই জাহাজটি ছিল চট্টগ্রামে। খুলনায় যেতে হলে আমার দপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু তারা আমাদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেয়নি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাহাজটি চট্টগ্রামে সার্ভে করাতে ব্যর্থ হয়ে গত মে মাসের মাঝামাঝি নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক অফিসে নতুন করে সার্ভের জন্য আবেদন করেন। আবেদনে রূপসা নদীতে জাহাজটির অবস্থান বলে উল্লেখ করা হয়। মেরিন হোয়াইট ফিস ট্রলার ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. জানে আলম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘ড্রিম সী একটি কাঠের তৈরি ছোট্ট ট্রলার ছিল। তাদের ওইসময়ে ট্রায়াল পারমিশন ছিল। ট্রলারটির দীর্ঘদিন সদরঘাটে থাকতে থাকতে ভেনিশ (নিশ্চিহ্ন) হয়ে গেছে। এতো বছর পরে গিয়ে কে বা কারা এটির নামে এখন স্টিল বডির বড় জাহাজ বানিয়ে অনুমোদনের চেষ্টা করছে।’
নৌ-বাণিজ্য দপ্তর খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়র মাহমুদুর রহমান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘মো. শাহজাহান শেখ নামের এক ব্যক্তি জাহাটি সার্ভের জন্য আবেদন করেছেন। আমি ও আমার স্টাফরাসহ ফাইলটি পর্যালোচনা করেছি। দুই/তিন দিন আগে ফাইলটাতে দেখেছি আদালতের অর্ডার আছে। এজন্য আমি আর এগুইনি। এটিতে আমার এখতিয়ার নেই। এটি প্রিন্সিপাল অফিসারের এখতিয়ার। এজন্য আমি জাহাজটি সার্ভে করিনি, সার্টিফাইও করিনি। তাছাড়া আবেদনের ফাইলটিতে গোঁজামিল রয়েছে। আর যখন দেখেছি ফাইলটি চিটাগংয়ের, তখন আর আমি আগাইনি।’
তিনি বলেন, ‘লোকটি (আবেদনকারী) আমার পূর্ব পরিচিত ছিল। ওনার অনেক জাহাজ আমি চট্টগ্রামে সার্ভে করেছি। আমি ওনাকে বলে দিয়েছি, ভাই আমি এটি সার্ভে করতে পারব না। আমার দুঃখ লেগেছে, তারা (আবেদনকারী) মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাকে বিপদে ফেলতে চেয়েছে। জাহাজটিকে আবেদনে স্টিল বডি দেখানো হয়েছে। আবেদনে জাহাজটির লোকেশন তারা রূপসা নদীতে দেখিয়েছে। আবেদনে দেওয়া জিআই সার্টিফিকেট অনুযায়ী এটির দৈর্য্য ২৫ মিটার, প্রস্ত ৬ মিটার এবং উচ্চতা ৩ মিটার উল্লেখ রয়েছে। এটির স্টোরেজ ক্যাপাসিটি ১৪২ দশমিক ৫৭ টন।’ নৌ-বাণিজ্য দপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘চট্টগ্রামে জাহাজ মালিকদের পক্ষে অনেক ব্রোকার (দালাল) রয়েছে, তারা মালিকের পক্ষে নৌ-বাণিজ্য দপ্তরে আবেদন করেন। এসব ব্রোকারদের সাথে জাহাজ মালিকের সখ্যতা থাকে।’ তিনি বলেন, ‘আদালত আদেশে প্রতিস্থাপনের অনুমতি দিতে পারে। এজন্য পূর্বেরটি মতো সম পর্যায়ের ট্রলার প্রতিস্থাপন পেতে পারে। কিন্তু কয়েকগুণ বেশি বড় জাহাজতো প্রতিস্থাপন করা যাবে না।’