কর্ণফুলীতে ৬ কোটি টাকা ঘুষে ৫৮৪ কোটি টাকার এক আজগবি প্রকল্প!

বাতিল চেয়ে ৫ মন্ত্রণালয়ে দ্বারস্থ

জে. জাহেদ, নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার , ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ১০:০০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি ড্রাই ডকইয়ার্ড কোম্পানি থেকে সাবেক এক উপজেলা চেয়ারম্যান ও এক ঠিকাদার ৬ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে একনেকে পাস করা ৫৮৪ কোটি টাকার এক বিতর্কিত প্রকল্প বাতিল চেয়ে পাঁচ মন্ত্রণালয় ও দুই দপ্তরে অভিযোগ পড়েছে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত এক পৃষ্টার একটি অভিযোগ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও অর্থ বিভাগের সচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সচিব ও সড়ক ভবনের প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে জমা হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) যেটি ‘চাতরী (চৌমুহনী) সিইউএফএল-কর্ণফুলী ড্রাইডক (মেরিন একাডেমি) ফকিরনিরহাট (এন ১২৯) জাতীয় মহাসড়ক যথাযথ স্থান-মান প্রশস্ততায় উন্নতিকরণ শীর্ষক প্রকল্প নামে পরিচিত।

চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী-আনোয়ারা উপজেলার এলাকাবাসীর পক্ষে মো. হারুন চৌধুরী, ইনামুল হোসেন, আব্দুল শুক্কুর, মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও এএম মোহাম্মদ নূর উদ্দিন নামে পাঁচ ব্যক্তি এই অভিযোগটি করেন।

এতে ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি ডকইয়ার্ড কোম্পানীকে ট্রান্সপোর্ট সু্বিধা দিতে দুরভিসন্ধিমূলক ভাবে সরকারি ৫৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয় বলে তা বাতিলের দাবি জানান তাঁরা।

তাঁরা জানিয়েছেন, দুই উপজেলার অধিকাংশ মানুষের অগোচরে বিগত ২০২৩ সালের শেষের দিকে তড়িগড়ি করে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকার সমীক্ষাহীন ভাবে প্রকল্পটি একনেকে পাস করেন।

মন্ত্রণালয়ের কাছে অভিযোগকারীরা জানান, সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ) এ প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা কাজ শুরু করেন। এতে কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা, বড়উঠান ও শিকলবাহা ইউনিয়নসহ আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়নে সওজের সার্ভেয়ার এসে রাস্তা বর্ধিতকরণ ও জমি অধিগ্রহণের কথা বললে এলাকাবাসী বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারেন। তা না হলে তাঁদের বাড়িঘরের উপর দিয়ে যে, এত বড় একটা মেরিন একাডেমি সড়ক হচ্ছে তা কেউ জানতেন না।

লোকজনের দাবি, তাঁদের ৫’শত বছরের পুরনো জনবসতি। যে জায়গা দিয়ে এই সড়কের প্ল্যান ও অধিগ্রহণ ম্যাপ সে জায়গা জুড়ে রয়েছে হাজার হাজার পাঁকা, সেমিপাকা ও দ্বিতল ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, খামার, বাজার, স্কুল, মাজার, মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে।

এ সড়কটি করলে এসব স্থাপনাসহ ২০ হাজার মানুষ তাঁদের ঘরবাড়ি হারাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য এলাকায় গিয়ে তাঁদের নতুন করে বসতি স্থাপন করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ প্রকল্প কিভাবে কারা পাস করিয়েছেন তার খোঁজ খবর নিলে লোকেমুখে তাঁরা শুনতে পেয়েছেন, এক সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এবং এক ঠিকাদার কর্ণফুলী নদী তীর সংলগ্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন ড্রাই ডকইয়ার্ড কোম্পানি থেকে ৬ কোটি টাকার আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করেন।

সূত্রে আরও জানায়, তাঁরপর ওই কোম্পানিকে ট্রান্সপোর্ট সুবিধা দিতে সরকারি ৫৮৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি গোপনে একনেকে পাস করিয়েছেন। যেখানে সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও সড়ক সেতু সচিবকে ব্যবহার করেছেন। সড়ক সচিব ও সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বাড়ি যেহেতু কর্ণফুলী-আনোয়ারায়। সেটাকে কাজে লাগিয়েছেন ওই চেয়ারম্যান ও ডকইয়ার্ড কোম্পানীর লোকজন। যা তদন্ত করলে আরও বিস্ময়কর তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে তাঁরা অভিযোগে জানান।

আবেদনকারী লোকজন জানিয়েছেন, কেন একজন ব্যক্তিকে সুবিধা দিতে জনগণের ৫৮৪ কোটি টাকা জলে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছেন! তা লোকজনের বোধগম্য নয়, কারণ বহু আগেই প্রায় তিন কোটি ব্যয়ে মেরিন একাডেমি নামক আরেকটি সড়ক নির্মাণ করা রয়েছে। সে সড়কেও গাড়ি চলে অপ্রতুল। বিপরীতে টানেল সংযোগ সড়কে ৪ ও ৬ লেনের রাস্তা সচল হচ্ছে।

সূত্রে জানা গেছে, তারপরেও কিছু অতিলোভী লোকজন সাধারণ মানুষকে বোকা বানাতে লুটপাট করার উদ্দেশ্যে একনেকে আজগবি এই প্রকল্পটি পাস করেন। এ প্রকল্পে তাঁরা জায়গা অধিগ্রহণ করে সড়কটি আনোয়ারার চাতরী (চৌমুহনী) হয়ে সিইউএফএল দিয়ে কর্ণফুলী ড্রাইডক পর্যন্ত কৌশলে বর্ধিত করার চিন্তা নেন। যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রনোদিত একটি লুটপাটের প্রকল্প ছাড়া কিছুই নয় বলে এলাকাবাসীর ক্ষোভ।

কেননা, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি প্রকল্পের উদ্দেশ্যই ছিলো মহাসড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিতকরণ। কিন্তু এ প্রকল্পের তার কিছুই নেই মোটকথা অন্তঃসারশূন্য। এমনকি এই লুটপাট প্রকল্পের কাজ শুরু না হতেই সড়ক বিভাগের কিছু প্রকৌশলী ও সার্ভেয়ারগণ অধিগ্রহণের প্রস্তাবিত জমির দাগ নয়-ছয় করে প্রতিবেদন দিয়ে রাতারাতি গ্রামের নিরীহ লোকজন থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, এ সড়ক নির্মাণ করলে সাধারণ জনগণ তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোন ভূমিকা রাখবে কিনা, এমনকি জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা কারো ব্যক্তি স্বার্থে ব্যয় করা যুক্তিযুক্ত কিনা, তা অধিকতর তদন্ত ও সমীক্ষা করা আবশ্যক বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।

পাশাপাশি টানেল অভিমুখে ৪ ও ৬ লেনের এতগুলো সড়ক থাকার পরও কেন সড়ক প্রশস্তকরণের নামে পশু খামার ও বাড়িঘরের উপর দিয়ে নতুন সড়ক নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা পড়েছে তার আমলনামা বের করারও দাবি জানিয়েছেন।

কোন কুচক্রীমহল যেন সাধারণ মানুষের বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন করে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ডেইরি জোনকে ধ্বংস না পারেন। এ জন্য অতিদ্রুত প্রকল্পটি বাতিল করে জনহিতকর নতুন প্রস্তাবনা নিতে আবেদন জানিয়েছেন হারুন চৌধুরীসহ পাঁচ আবেদনকারী।

এ ধরনের প্রকল্প বিষয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন গণমাধ্যম কে বলেন, ‘যেহেতু এখন জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। সংসদ সদস্যরাও নেই। তাই এই প্রকল্পের আর কার্যকারিতা নেই। প্রকল্পটি বাতিল করা হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম : অনন্য যুগে যুগে
পরবর্তী নিবন্ধঅবৈধ সম্পদ আয় : স্ত্রীসহ বাঁশখালীর সাবেক চেয়ারম্যান লেয়াকত দুদকের জালে