শতাব্দীর ভয়াবহতম সময় পার করেছে বিশ্ব ২০২০ সাল। পৃথিবীর প্রতিটি জনপদের প্রতি ইঞ্চি মাটির প্রতিটি অণু পরমাণুতে লেপ্টে আছে মহাশক্তিধর আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আসা করোনা সৈন্যের ভয়ংকর বিষাদ চিহ্ন। এ ভয়াল দুর্দিন দেখেনি বিশ্ব কোনোদিন, কোনোকাল। লাখ লাখ মানুষ করোনার নীরব ঘাতক কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে স্থায়ী জীবনের তলদেশে তলিয়ে গেছে আর এখান থেকে শুরু হয়ে গেছে সেসব হতভাগা আদম সন্তানদের কেয়ামতের প্রথম পর্যায়। এর কোন অংশেই ব্যতিক্রম নয় সুজলা-সুফলা-শস্য শ্যামলা নয়নাভিরাম এ বাংলার জমিন। বাংলার প্রতি ইঞ্চি মাটিতে করোনার ক্ষত এখনো লেগে আছে যেন। শতাব্দির ভয়াবহতম সময় পার করেছে এ দামাম বাংলা (এপ্রিল, মে ও জুন ২০২০)। করোনার ভয়াল থাবায় ক্ষত বিক্ষত করেছে বীর প্রসবিনী বাংলার প্রতিটি মানুষকে। পৃথিবীর একমাত্র শ্রেষ্ঠতম জীবন বিধান ইসলামের প্রতিটি নীতিকে, প্রতিটি বাণীকে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতায়ালার জমিনে রোপন করতে পারেনি বলে আসমানি আযাব ভর করেছে এ সবুজের উপর। মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিয়েছে হাজারো মানবতা, চাকরিচ্যুত হয়েছে অনেকেই, ধস পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে, মন্দা লেগেছে অর্থনীতিতে। এমন অনেক সমাজ আছে, পরিবার আছে, ব্যক্তি আছে যাদের চোখে মুখে গভীর অসহায়ত্বের ছাপ। অভাবের তাড়নায় নিষ্পেষিত আমার আল্লাহতায়ালার সৃষ্টিকূল, শামিল হয়েছে মিসকীনদের কাতারে। মান সম্মানের ভয়ে অব্যক্ত কথাটুকুন ব্যক্ত করে না কস্মিনকালেও। ঘরে ঘরে রোনাজারী, নীরব আর্তনাদ যেন কেঁপে উঠে আমার আল্লাহর আরশ। শোকের বেলাভূমিতে একদিন সবটুকুর আয়োজন ছিল আর এখন করোনার প্রভাবে সবই তছনছ, উলোট-পালট সমীকরণ। কোন কোন প্রতিষ্ঠান লে-অফ ঘোষণা করা হয়েছে, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান, কারো বেতন অর্ধেক কিংবা তিন ভাগের এক ভাগে নামিয়ে আনা হয়েছে কিংবা কারো চাকরির চিরতরে অবসান হয়েছে-এ তো চিত্র করোনাকালের। আমরা খুঁজে খুঁজে বের করে আনব আঁধারের সেই বিন্ধ্যাচল, মুক্ত করব অসহায়ত্বের বন্দীশালা থেকে। ‘(দান সদকা তো এমন) কিছু গরীবদের জন্যে, যাদের আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপৃত করে রাখা হয়েছে যে, তারা (নিজেদের রেযেকের জন্যে) যমীনের মুখে চেষ্টা সাধনা করতে পারে না, আত্নসম্মানবোধের কারণে এরা কিছু চায় না বলে অজ্ঞ (মূর্খ) লোক এদের মনে করে এরা (বুঝি আসলেই) সচ্ছল, কিন্তু এদের (বাহ্যিক) চেহেরা দেখেই তুমি এদের (সঠিক অবস্থা) বুঝে নিতে পার, এরা মানুষদের কাছ থেকে কাকুতি মিনতি করে ভিক্ষা করতে পারে না; তোমরা যা কিছু খরচ করবে আল্লাহতায়ালা তার (যথার্থ) বিনিময় দেবেন, অবশ্যই তিনি সবকিছু জানেন’-সূরা বাকারা-২৭৩। এ ধরনের দান দিতে হবে অতি নীরবে, অতি নিভৃতে আর যারা নীরবে-নিভৃতে অসহায়দের দান করেন তারা সেই কঠিন কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহর আরশের নীচে ছায়া পাবেন আর এ ধরনের দানই হল উত্তম দান, ‘তোমরা যদি (তোমাদের) দানকে প্রকাশ কর-ভালো কথা (তাতে কোন দোষ নেই), তবে যদি তোমরা তা গোপন রাখ এবং (চুপে চুপেই) তা অসহায়দের দিয়ে দাও, তা হলে তোমাদের জন্যেই বেশি উত্তম’-সূরা বাকারা-২৭১। এ করোনাকালীন দুর্যোগ সময়ে অভাবের কারণে জর্জরিত হয়েছে লাখো মানুষ, কেউ বা আমাদের অতি কাছের প্রতিবেশী অথচ আমরা দিব্যি সুখের আবাহনে গা ভাসাই-এদের খবর রাখি না কেউ-অনাহারে-অর্ধাহারে তারা জীবন কাটায় প্রতিটি ক্ষণ। আমরা কি সচ্ছল ব্যক্তিরা পেরেছি তাদের মুখে হাসি ফোটাতে? আর যারা এ সব অসহায় মিসকীনদের-যারা করোনাকালে কঠিন অভাবের কবলে পড়েছে তাদের কাছাকাছি আসেন, তাদের হৃদয় দিয়ে ভালোবাসেন তারাই তো আল্লাহর কাছে উত্তম প্রতিদান পাওয়ার যোগ্য, ‘এরা শুধু আল্লাহর ভালোবাসায় (উদ্বুদ্ধ হয়েই ফকির) মিসকীন, এতিম ও কয়েদিদের খাবার দেয়, (এরা বলে) আমরা শুধু আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্যেই তোমাদের খাবার দিচ্ছি, (বিনিময়ে) আমরা তোমাদের কাছ থেকে কোনরকম প্রতিদান চাই না-না (চাই) কোন রকম কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন’-সূরা আদ্ দাহর- ৮-৯। এ কঠিন করোনাকালে যারা চাকরিহারা অসহায়দের দান করে না তাদের ব্যাপারে ইসলাম কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। যারা স্বর্ণ-রৌপ্য কুক্ষিগত করে অথচ তার হক আদায় করে না, পরকালে তাদের বেদনাদায়ক শাস্তির ব্যাপারে পবিত্র কোরআন বলছে, ‘যারা স্বর্ণ-রৌপ্য কুক্ষিগত করে, আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না, তাদেরকে পীড়াদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। সেদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাটে, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে, (সে দিন বলা হবে) এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, তোমরা যা কুক্ষিগত করেছো তার মজা গ্রহণ কর’। হযরত আবু হুরাইরা (রা) সূত্রে ইমাম বোখারী (রাহ) মহানবী (সা) হতে বর্ণনা করেছেন যে, ‘যাকে আল্লাহ অর্থ দিয়েছেন অথচ সে তার যাকাত আদায় করেনি কেয়ামতের দিন তা ভয়ষ্কর অজগরের আকৃতি ধারণ করবে। তার থাকবে দু’টি মাথা। তাকে সে পেঁচিয়ে নিবে, অতঃপর তার দু’টি মুখ দিয়ে তাকে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার ধন’। আবার এ ধরনের দান করার পর অনেকেই আমরা দানগ্রহীতাকে খোঁটা দিয়ে থাকি যা আল্লাহতায়ালা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহর কোরআন বলছে, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা খোঁটা দিয়ে এবং কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান-সদকা বরবাদ করে দিও না’-সূরা বাকারা- ২৬৪। এ করোনাকালে কত অসহায় মানবতা মানবেতর জীবন যাপন করছে তার খবর কি আমরা রেখেছি কখনো? আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন কঠিন দুর্যোগের সময় অনাহারে থেকেছে, অর্ধাহারে থেকেছে তার কি কোন খোঁজ নিয়েছি? অথচ আমার আল্লাহতায়ালা তাদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এভাবেই, ‘এ হচ্ছে সে ব্যক্তি যে (নিরীহ) এতিমকে (গলা) ধাক্কা দেয়, মিসকীনদের খাবার দিতে কখনো যে (অন্যদের) উৎসাহ দেয় না’-সূরা আল মাউন-২-৩। আমরা মিসকীনদের সাধ্যমত সহযোগিতা করব আর এটাই হোক এ সময়ের অন্যতম অনুষঙ্গ। করোনার ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত গরীব আত্মীয় স্বজন, গরীব প্রতিবেশী, চাকরিহারা অসহায় মানুষদের পাশে থাকা এ সময়কালের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি আর এতেই খুশি হবেন আমার মাবুদ মহান রাব্বুল আ’লামিন, এর প্রতিদান পাওয়া যাবে প্রতিটি পদে পদে আর নীরবে দানকারীরা স্থান পাবেন কঠিন বিচার দিবসের একমাত্র ছায়া আল্লাহর আরশের ছায়ার নীচে।
লেখক : সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল