কবিতা তাঁর কাছে তীর্থস্থান, গান লিখেছেন ভালোবেসে। একই সাথে দাপুটের সাথে একের পর এক প্রচ্ছদ এঁকে গেছেন। বলছিলাম সত্তর দশকের তুখোড় কবি ও গীতিকার খালিদ আহসানের কথা। তার লেখনির একটা আলাদা মাত্রা আছে। কবিতায় তিনি তাঁর হৃদয়কে অবারিত করে দেন। তবে তিনি তাঁর হৃদয়কে শুধু কবিতা বা গান নয়, তিনি দেশের প্রথম সারির একজন প্রচ্ছদ শিল্পী। স্বাধীনতার পরে অধিকাংশ প্রধান লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন তিনি। খালিদ আহসান ছিলেন মননে চিন্তায় আধুনিক একজন মানুষ। গতকাল ১৮ নভেম্বর শিল্পকলা একাডেমি, চট্টগ্রামে কবি ও চিত্রশিল্পী খালিদ আহসানের ‘করোনাকালীন কবিতা’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও তিন দিনব্যাপী চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আলোচকবৃন্দ এ অভিমত ব্যক্ত করেন। শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। পরে মিলনায়তনে আবৃত্তিকার রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, সমাজ সংগঠক গোলাম মোস্তফা কাঞ্চন। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন কবিপত্নী, ডিজাইনার আইভি হাসান। সমাপনী বক্তব্য রাখেন ক্রিয়েটিভ ওয়ার্কশপের পক্ষে শাহরিয়ার আদনান শান্তনু।
দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, খালিদ আহসানের শিল্প সত্তার সাথেই আমরা কম বেশি পরিচিত ছিলাম। আজ এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিল্প সত্তাকে ছাপিয়ে কবি খালিদ আহসান আমাদের কাছে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। দুঃখটা এই যে, যখন এটি জানতে পারলাম তখন খালিদ আর আমাদের মাঝে নেই। শিল্পী আর তার শিল্পকর্ম একটা সময় এসে একাত্মা হয়ে যায়। খালিদ আহসানও যখন যে কাজে হাত দিয়েছে, তাকে নিজের মতো গড়ে তুলেছে। তিনি বলেন, জীবন একটা নোটবুকের মতো, যার প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠায় লেখা হয়ে গেছে। ভেতরের পাতাগুলো ভরাটের দায়িত্ব আমাদের। খালিদ তার সৃষ্টি দিয়ে ভেতরের পাতাগুলো সযতনে ভরিয়ে তুলেছে। তার সৃষ্টিকর্ম তাই এখন তার হয়ে কথা বলছে, আমরা মুগ্ধ হয়ে তার চিত্রকর্ম দেখছি, মন ভরে তার কবিতা পড়ছি আর তার মধ্যে খালিদকে খোঁজার চেষ্টা করছি। খালিদ আহসান যতদিন বেঁচেছে, প্রাণ খুলে বেঁচেছে। কারণ সে জানতো জীবন ক্ষণস্থায়ী। আমরা প্রত্যেকেই আজ আছি, কাল থাকবো কিনা জানি না। আজকের জীবনটাতে আগামী প্রজন্মের জন্য কিছু করে যাওয়ার মাঝেই জীবনের সার্থকতা। খালিদ আহসান ছিল বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। একাধারে শিল্পী, কবি, গীতিকার। এত পরিচয়ের মাঝেও তার কবি সত্ত্বাই তাকে অনন্য করে তুলেছে। অন্যগুলো হলো কবিতার ছায়া। খালিদ আহসান তার কর্মের মাধ্যমে আমাদের চিন্তায়, মননে চির জাগরুক থাকবে।
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, খালিদ আহসান ছিল এক অর্থে সব্যসাচী। কবিতা কারও কাছে শিখতে হয় না। নিজের থেকে কবিতা লেখার প্রেরণা মিলে। কিন্তু শিল্পকর্ম শিখতে হয়। এ ক্ষেত্রে খালিদ স্বশিক্ষিত শিল্পী। কবিতা লেখা বা ছবি আঁকায় খালিদের নিজস্ব একটা ধরণ ছিল। তবে সর্বার্থে সে ছিল একজন মৌলিক মানুষ। খালিদ ভাবুকতার জগতের মানুষ। তার সৃষ্টিতে সে চেষ্টা করেছে আবেগতাড়িত ভাবনা তুলে আনতে। তার মধ্যে রোমান্টিকতার প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রমেই একটি কঠিন গদ্যময় জগতে পরিণত হয়েছে। কাজেই তার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করতো। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশটা ঢাকা কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। তাই ঢাকার বাইরে থাকলে তার সন্ধান অন্যরা পায় না। কিন্তু উন্নত বিশ্ব তা নয়। খালিদকে তবু ভাগ্যবান মানতে হবে, কারণ ঢাকার কবিরাও প্রচ্ছদের জন্য তার খোঁজ করেছে। কিন্তু তার কবিতার খোঁজ কি কেউ করেছে? এ নিয়ে তার কোনো ভাবনাও ছিল না। অন্যে তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করলো কিনা তার তোয়াক্কা সে কখনো করেনি। নিজের জীবনের পরিসরকে ছাপিয়ে এমন কিছু রেখে যাওয়া- এটাই তার সার্থকতা।
সমাজ সংগঠক গোলাম মোস্তফা কাঞ্চন বলেন, মানুষ পৃথিবী থেকে একদিন না একদিন বিদায় নেবে, এটাই জগতের নিয়ম। কিন্তু রেখে যায় স্মৃতি। এ স্মৃতির মাধ্যমে মানুষ বেঁচে থাকে। খালিদ আহসানের সংস্কৃতি চর্চার উৎস তার মা। সাহিত্য পরিমণ্ডলে সে নিজেকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু তার অকালমৃত্যু কিছুতেই মেনে নেওয়ার নয়। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, সে যদি আরও কিছুদিন বাঁচতো তবে এ দেশের মানুষকে আরও কিছু সৃষ্টি দিয়ে যেতে পারতো। আমরা তাই ব্যথিত। তার মতো সহজ সরল খাঁটি মানুষ এ সমাজে বিরল।
অনুষ্ঠানে খালিদ আহসানের জীবনচরিত এবং মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে শুভানুধ্যায়ীদের ভাবনা সম্বলিত ভিডিও ক্লিপ প্রদর্শিত হয়। এছাড়া খালিদ আহসানের কবিতা আবৃত্তি করেন শিল্পী রাশেদ হাসান, শিল্পী কংকন দাশ ও নরেন আবৃত্তি একাডেমির শিল্পীবৃন্দ।