কক্সবাজারে চিংড়ি পোনার হ্যাচারিতে বাড়ছে উৎপাদন

বিএফআরআই বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত দেশীয় প্রজাতির মাইক্রোঅ্যালগি ব্যবহার

আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার | শনিবার , ১৯ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:১১ পূর্বাহ্ণ

বিদেশ থেকে আমদানি করা মাইক্রোঅ্যালগির পরিবর্তে বিএফআরআই বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত দেশীয় প্রজাতির মাইক্রোঅ্যালগি (সামুদ্রিক হেজালা বা আগাছা) ব্যবহার করে লাভবান হচ্ছেন চিংড়ি ও কাঁকড়া পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারি মালিকরা। দেশীয় প্রজাতির মাইক্রোঅ্যালগি ব্যবহারের ফলে একদিকে পোনা উৎপাদনের হার ২০% বেড়েছে, অন্যদিকে বাড়ছে পোনার গুণগত মান। এর সাথে সাশ্রয় হচ্ছে মূল্যবান বৈদেশিক অর্থও।

এমন তথ্য জানান শ্রিম্প হ্যাচারি এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সেব) সভাপতি ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য লুৎফুর রহমান কাজল। তিনি জানান, কক্সবাজারটেকনাফ সমুদ্র তীরে গড়ে ওঠা ৬০টি বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারি থেকে উৎপাদিত পোনার ওপর ভিত্তি করে দেশের প্রায় ৩ লাখ হেক্টর জমিতে রপ্তানিযোগ্য চিংড়ি ও কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। গভীর সমুদ্র থেকে মা চিংড়ি ধরে এনে হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে ডিম ফুটিয়ে তৈরি করা হয় পোনা। আর সেই পোনা প্রতিপালনের জন্য হ্যাচারিতে খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল বিদেশ থেকে আমদানিকৃত আর্টিমিয়া ও মাইক্রোঅ্যালগি। কিন্তু বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মাইক্রোঅ্যালগিকে জীবাণুমুক্ত বা রোগমুক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় পোনা উৎপাদনে এর প্রভাব পড়ে। এর ফলে অনেক হ্যাচারি মালিক ব্যাপক লোকসান গোনে। অনেক হ্যাচারি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিএফআরআই বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত দেশীয় প্রজাতির মাইক্রোঅ্যালগি হ্যাচারি মালিকদের নতুন পথ দেখিয়েছে। এর ফলে একদিকে পোনা উৎপাদনের হার প্রায় ২০% বেড়েছে, অন্যদিকে পোনার গুণগত মানও বেড়েছে।

সেব সূত্র জানায়, কক্সবাজারের বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিসমূহে প্রতি বছর ১ হাজার ৮০০ কোটি থেকে দুই হাজার কোটি পর্যন্ত পোনা উৎপাদন করা হয়। এর জন্য ৬০৭০ হাজার মা চিংড়ির প্রয়োজন হয়। একেকটি মা চিংড়ি থেকে ৩ লাখ থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত ডিম পাওয়া যায়। সে ডিম বড় করতে করতে মাত্র ৩০% পোনা বেঁচে থাকত। আর এখন সেটা প্রায় ৫০% ভাগে উন্নীত হয়েছে।

বিএফআরআই সূত্র জানায়, কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কেন্দ্র প্রধান ড. শফিকুর রহমানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকিয়া হাসান, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম ও তুরাবুর রহমান ২০১৮ সাল থেকে নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে সম্প্রতি এই সাফল্য অর্জন করেন।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কেন্দ্র প্রধান ড. শফিকুর রহমান জানান, বিএফআরআই বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে হ্যাচারিতে পোনার খাদ্য উপযোগী কয়েক প্রজাতির মাইক্রোঅ্যালগি বঙ্গোপসাগরে শনাক্ত করেন এবং এরপর ইনডোর পর্যায়ে বিভিন্ন স্তরে গবেষণার মাধ্যেমে এর পুষ্টিগুণ ও গ্রোথ নিশ্চিত হয়ে বিএফআরআই লাইভ ফিড গবেষণাগার হতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারিবেসরকারি পর্যায়ের চিংড়ি, কাঁকড়া, কোরাল হ্যাচারিতে এ পর্যন্ত ৪০৬ বারে ৪ টনের বেশি বিশুদ্ধ অ্যালগি স্টক বিনামূল্যে প্রদান করেন। বর্তমানে স্টক প্রাপ্যতা আরো সহজ করার লক্ষ্যে বিএফআরআই গবেষণার সম্প্রতি অ্যালগি স্টক পণ্য তৈরি করেছে। নতুন উদ্ভাবিত এ অ্যালগি পণ্য ব্যবহারের সুবিধার্থে প্রজাতিভেদে ৭৪৫ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। দেশের যেকোনো প্রান্তে স্টক সরবরাহ ও পরিবহনে এ উদ্ভাবন বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

তিনি জানান, বিএফআরআই কক্সবাজারের লাইভ ফিড গবেষণাগারে বর্তমানে স্কেলেটোনিমা কস্টাটাম, চিটোসেরোস গ্রাসিলিস, থ্যালাসিওসিরা ও ন্যানোক্লোরোপসিসসহ ১০টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির স্টক অভিযোজনের মাধ্যমে সংরক্ষিত রয়েছে। এ প্রজাতিগুলোর মধ্যে কক্সবাজারস্থ বাগদা চিংড়ি হ্যাচারিসমূহে স্কেলেটোনিমা কস্টাটাম, ভেনামি চিংড়ির হ্যাচারিসমূহে চিটোসেরোস গ্রাসিলিস ও থ্যালাসিওসিরা প্রজাতির এবং কাঁকড়া ও কোরাল মাছের হ্যাচারিসমূহে ন্যানোক্লোরোপসিসসহ প্রজাতির মাইক্রোঅ্যালগি বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা জানান, মাইক্রোঅ্যালগি একটি এককোষী অতি আণুবীক্ষণিক জীব, যা সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং সূর্যালোককে প্রয়োজনীয় জৈব রাসায়নিক পদার্থে রূপান্তর করে অক্সিজেনকে উপজাত হিসাবে উৎপন্ন করে। বিশ্বে প্রায় এক লক্ষ প্রজাতির মাইক্রোঅ্যালগি রয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ৭০ ভাগ অক্সিজেন আসে এই অ্যালগি থেকে। পুষ্টিগুণ বিচারে মাইক্রোঅ্যালগিকে ভবিষ্যৎ সুপার ফুড কিংবা প্রোটিনের আদর্শ বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন বিজ্ঞানীরা। মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর লার্ভাল অবস্থায় মাইক্রোঅ্যালগি প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হ্যাচারি পর্যায়ে চিংড়িসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের সুস্থ পোনা উৎপাদনের জন্য নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উৎপাদিত নির্দিষ্ট প্রজাতির মাইক্রোঅ্যালগি ব্যবহার অত্যাবশ্যকীয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ১৮ এপ্রিলকে জাতীয় যুব দিবস ঘোষণা করার দাবি
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে ছুরিকাঘাতে স্ত্রীকে হত্যার পর পালাল স্বামী