ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বে কখনো সরকারি সম্পত্তি বেদখলের তালিকা করা হলে নিশ্চিত করে বলা যায় বাংলাদেশ হবে প্রথম। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে দেশের লাখ লাখ একর সরকারি সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে।এতে নদী নালা খাল বিল পুকুর পাহাড় থেকে শুরু করে এমন কোন সরকারি প্রতিষ্ঠান নেই যার সম্পত্তি বেদখল হয় নেই। আগে আমাদের দেশে প্রত্যেক জেলায় বা অঞ্চলে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা যেমন রাজবাড়ী, দিঘি, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোটা, নদী, খাল, পাহাড় ইত্যাদি ছিলো। যার বেশিরভাগই ইতিমধ্যে বেদখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনাও রয়েছে, যেগুলো আমাদের জন্য ছিলো অমূল্য সম্পদ। তেমনই একটি সম্পদ হলো ঢাকার সেয়ারীঘাটের বিপরীতে কেরানী গঞ্জে অবস্থিত জিঞ্জিরা প্রাসাদ।এই প্রাসাদটি ১৬২০ -২১ সালে নির্মাণ করেন সুবেদার ইব্রাহিম খাঁ। ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীন সূর্য অস্তমিত অর্থাৎ নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতনের পর মীর জাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে মুর্শিদাবাদ হতে নবাবের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা, কন্যা উম্মে জোহরা, মা আমেনা বেগম, নানা আলীবর্দি খার প্রধান রানী শরফুন্নেসা ও খালা চক্রান্ত কারী ঘসেটি বেগমকে এনে এই প্রাসাদে বন্দি করে আট বছর রাখা হয়েছিলো। যদিও পরে আবার তাদেরকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করা হয় তবে ঘসেটি বেগমকে বুড়িগঙ্গায় জ্যান্ত ডুবিয়ে মারা হয়েছিলো। স্বাধীন বাংলার গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি আজ পুরোপুরি বেদখল হয়ে গেছে। সেখানে এখন বহুতল মার্কেটসহ বহু স্থায়ী স্থাপনা গড়ে উঠেছে। অথচ এই ধরনের একটি স্থাপনা একটি দেশের জন্য কত বড় সম্পদ সেটা আমরা আন্দাজও করতে পারি না।এক সময় ভাওয়াল রাজার জমিদারি বিস্তৃত ছিল টাংগাইল হতে ঢাকা পর্যন্ত যাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থাপনা ছিলো। কালের বিবর্তনে সেই সব স্থাপনা ও সম্পত্তি আর অবশিষ্ট নেই। সবগুলো বেদখল হয়ে গেছে। এই জমিদারিতে অবস্থিত ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোও ছিলো দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।এই ধরনের আরো একটি স্থাপনা ছিলো নওগাঁ জেলার দুবলহাটি জমিদার বাড়ি। সেটিও বেদখল হতে হতে বিলুপ্তির পথে । চট্টগ্রাম জেলায়ও এই ধরনের অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ছিলো।এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি স্থাপনা হলো চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি জমিদারবাড়ি। যেটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিলো।এখানে ছিলো ৬০ কক্ষের একটি বিশাল প্রাসাদ।এটি ফটিকছড়ি উপজেলার ভূজপুরের কাজিরহাট বাজারের দক্ষিণ- পশ্চিমে একটি টিলার উপর অবস্থিত। বর্তমানে এটি কাজিবাড়ি বা মিয়াবাড়ি নামে পরিচিত। বাড়িটিতে ঢুকার সময় প্রথমেই রয়েছে ৩ গম্বুজ ও ১২ মিনারযুক্ত একটি মসজিদ।যা মোগল স্থাপত্যশৈলীর আদলে তৈরি করা।মসজিদ পেরিয়ে গেলে কবরস্‌হান।এর ১০০ গজ পরেই ছিলো ২০০ ফুট লম্বা ৬০ কক্ষের রাজপ্রাসাদটি।এই প্রাসাদের একটি বিশেষত্ব হলো,এতে একটি ফাঁসির মঞ্চ ছিলো যা বর্তমানে ধ্বংস প্রাপ্ত। যাতে বছরে অন্তত ৭ জনকে ফাঁসি কার্যকর করার এখতিয়ার ছিলো।তদানিন্তন ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে জমিদার কাজী শাহাবুদ্দীন চৌধুরী ফাঁসি কার্যকর করার সনদ পেয়েছিলেন এবং সেই সনদ মূলে ফাঁসির আদেশ ও ফাঁসি কার্যকর করা হতো।১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এই জমিদারি চালু ছিলো,যার বিস্তৃতি ছিলো ফটিকছড়ির অর্ধশত বর্গকিলোমিটার এলাকা। ১৭৬৫-১৮৪৫ইং সালের মধ্যে এই জমিদারির আওতায় ২২টি মোগল স্থাপত্য আদলের মসজিদ,২২টি কালভার্ট ও ২২টি দিঘি খনন করা হয়। যার বেশীরভাগই এখন বেদখল হয়ে গেছে।সেই ঐতিহাসিক প্রাসাদটিও এখন আর টিকে নাই। কালের সাক্ষী হয়ে আছে শুধু কয়েকটি দেওয়াল। অথচ এই প্রাসাদটিও একটি অমূল্য সম্পদ ছিলো। যা আমরা রক্ষা করতে পারিনি। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময়ও এই দেশের পথে ঘাটে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছিল। যার বিস্তৃতি ছিল পুরো দেশব্যাপী। এখন আমার আপনার আশে পাশে খেয়াল করে দেখুন, সেগুলো আছে কিনা? দেখবেন হয় দখল হয়ে গেছে না হয় পুরানো ঐতিহ্য ভেঙে নতুন কিছু করা হয়েছে।এই যে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দখল ও ঐতিহ্য ধ্বংস করা হয়েছে,এগুলো কে করেছে? সব আমাদের পরিচিত লোকজন যারা সেই এলাকার প্রভাবশালী নামে পরিচিত।এর সাথে সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত রয়েছে। যারা এইসব সরকারি সম্পত্তি বেদখলে সহায়তা করে কোটি কোটি টাকা আয় করেছে। অর্থাৎ যারা সরকারি সম্পত্তি রক্ষা করার দায়িত্বে ছিলেন তারাই এর বেদখলে সহায়তা করেছে। যদিও এই জন্য তাদের কোন জবাবদিহি করতে হয় নাই। একটি দেশের আয়তনের ২৫% বনাঞ্চল থাকলে সেই দেশকে পরিবেশ বান্ধব দেশ বলা হয়। আমাদের দেশ অধিক জনবহুল হওয়ায় আগে থেকেই বনাঞ্চল কম ছিলো। বর্তমানে তা ৭-৮% এ ঠেকেছে এবং দিনকে দিন আরো কমছে। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, দেশের বৃহত্তম বনাঞ্চল সুন্দরবনে প্রতি বছর কোন না কোন এলাকায় আগুন লাগে বা লাগানো হয়।এতে করে সেই আগুন লাগা অংশের বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যায় ও নতুন বসতি স্থাপিত হয়।সে জন্য প্রতি বছর সুন্দরবনের আয়তন কমছে ও এর প্রাকৃতিক পরিবেশ বির্পযস্ত হচ্ছে। এতে সুন্দরী কাঠসহ জীব বৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলের ভিতরেও আগের মত গাছ পালা নেই। ভিতরে সব ফাঁকা। দেশে আগে চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় এলাকায় ছিলো গাছের প্রতিরক্ষা বেষ্টনী। যা এখন আর নেই। সে জন্য বর্তমানে সাইক্লোন ও ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশী হয়।
দেশে কয়েক দশক পর পর ভূমি জরিপ করা হয়।এই জরিপে মাঠকর্মীরা সরেজমিনে সমীক্ষা করে জরিপ কার্য্য পরিচালনা করে।এই জরিপ কাজ করতে গিয়ে মাঠকর্মীরা বিভিন্ন এলাকার দালাল,রাজনৈতিক নেতা কর্মী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে অবৈধ আঁতাত করে একজনের দখলি জমি অন্যের নামে রেকর্ড করে দেন। সরকারি খাস জমি বিভিন্ন লোকের নামে রেকর্ড করেন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে।এই ধরনের ভুল জরিপ দেশের সব জায়গায় ঘটেছে। আবার হয়ত মাঠ জরিপের খসড়ায় একরকম রেকর্ড করে চূড়ান্ত করার সময় আরেক রকম রেকর্ড করেছেন। সে জন্য দেশের আদালত গুলোতে শুধু জমি সংক্রান্ত লক্ষ লক্ষ মামলা বছরের পর বছর ধরে চলছে। এতে সাধারণ জনগণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। বছরের পর বছর মামলা চালাতে গিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যারা এই কাজগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ঘুষের বিনিময়ে করে গেছেন তাদের টিকিটিও কেউ স্পর্শ করতে পারে না। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রক্ষায় ও সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছে।এক্ষেত্রে আমরাই একমাত্র ব্যতিক্রম। মনে রাখতে হবে,একটা মানুষের যদি স্মৃতি না থাকে তবে সে একটা জিন্দা লাশে পরিণত হয়। তেমনি একটি দেশও যদি তার ঐতিহাসিক স্থাপনা ও ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে ফেলে তবে সেই জাতিও একটি মৃত জাতিতে পরিণত হয়। তাই অতি দ্রুত সরকারি সম্পত্তি ও ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। না হয় এমন এক সময় আসবে যখন দেশে আর কোন ঐতিহাসিক স্থাপনা অবশিষ্ট থাকবে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসন্তানের নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ তৈরিতে পরিবারের ভূমিকা
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশে চায়ের উৎপাদন এবং ব্যবহার