সন্তানের নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ তৈরিতে পরিবারের ভূমিকা

তারিফা হায়দার | মঙ্গলবার , ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ

বিস্ময়কর এই পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব । সেই আদিম যুগ থেকে সময়ের যত বিবর্তন ঘটেছে, সেই বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ তৈরি করেছে সমাজ, সৃষ্টি হয়েছে জাতি ও দেশ। সময় যত এগিয়েছে মানুষের মাঝে সামাজিক বন্ধন ততই দৃঢ় হয়েছে। মানুষ তার বিবেক কে কাজে লাগিয়ে মান ও হুশের জাগরণের ফলে অন্তরে সঞ্চার করেছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ, যাকে আমরা মানবতা বলে থাকি।
নৈতিকতা কাকে বলে তা বুঝতে হলে সর্বপ্রথম নীতি কি তা বুঝতে হবে। এক কথায় সমাজে দীর্ঘকালীন বিবর্তনের ফলে সকলের কল্যাণের উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া জীবন চর্চার প্রাথমিক নিয়মাবলীই হল নীতি। কোন সমাজের সকল মানুষ যখন তিল তিল করে গড়ে ওঠা সেই সকল নিয়ম-নীতি সম্পর্কে অবগত ও শ্রদ্ধাশীল হয়, কেবলমাত্র তখনই একটি সুষ্ঠু আদর্শ সমাজ গড়ে উঠতে পারে। মানুষের মধ্যে সামাজিক নীতির এই সার্বিক উদ্ভাসকেই বলা হয় নৈতিক শিক্ষা বা নৈতিকতাবোধ।
অনেক ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষা বা নৈতিকতাবোধকে মূল্যবোধের সঙ্গে সমার্থক বলে মনে করা হয়ে থাকলেও একটু চিন্তা করলে বোঝা যাবে নৈতিকতাবোধ এবং মূল্যবোধ এক নয়। মানব চরিত্রের এই দুটি উৎকৃষ্ট গুণ যা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত হলেও সমার্থক প্রকৃতির নয়।
সমাজের বুকে তিল তিল করে গড়ে ওঠা নৈতিক আদর্শ পালনের মধ্য দিয়ে মানব চরিত্র সঠিক-ভুল, উচিত-অনুচিত সম্পর্কিত যে বোধ তৈরি হয় তাকেই মূল্যবোধ বলে। নৈতিক আদর্শের সুষ্ঠু অনুশীলন ছাড়া এই মূল্যবোধ গড়ে উঠতে পারে না। আর যদি কোনো মানুষের মধ্যে সামাজিক তথা মানবিক মূল্যবোধের সার্বিক বিকাশ ঘটে তাহলে সংশ্লিষ্ট সমাজে সেই মানুষই উৎকৃষ্ট। আর পক্ষান্তরে মূল্যবোধহীনতা মানুষের জীবনকে ব্যর্থতার অন্ধকারএ নিমজ্জিত করে দেয়।
প্রযুক্তির কল্যাণে বর্তমান পৃথিবীর মানুষের জীবন যাপনের মান পরিবর্তন হলেও মেধা ও মনন দ্বারা পরিচালিত নৈতিক শিক্ষা দ্বারা মূল্যবোধকে জাগ্রত না করলে সমাজ কখনই সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না। মানুষে মানুষে পারস্পরিক সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কের দ্বারাই আদর্শ সমাজ তৈরি করা যায়। কিন্তু যখন মূল্যবোধহীন সমাজে মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক কৃত্রিমতা ও যান্ত্রিকতায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তখন সেই সমাজ প্রচলিত নিয়ম-নীতি দ্বারা পরিচালিত হলেও প্রাণহীন হয়ে পড়ে। সমাজে মূল্যবোধের এই ব্যাপক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে যুগে যুগে মনীষীগণ, ছেলেবেলা থেকেই মানব সন্তানের নৈতিক শিক্ষা গ্রহণের পক্ষে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন নৈতিক শিক্ষা ছাড়া মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের পূর্ণ বিকাশ ঘটবে না এবং মূল্যবোধহীন যে কোনো সমাজ অনাচারের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে।

সে জন্য প্রাচীনকাল থেকেই পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি সন্তানকে নৈতিকশিক্ষা ও মূল্যবোধ শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হত, যার প্রাথমিক শিক্ষাগার হল তার পরিবার। আমাদের মা-বাবা, ভাই-বোন কে নিয়ে এক একটি পরিবার গড়ে উঠে। একজন শিশু সন্তান জন্মের পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের পূর্বে ৪-৫ বছর পরিবারে বেড়ে ওঠে। এ সময়টিতে তার মানসিক বিকাশ ও নৈতিক চরিত্র গঠন হয়ে থাকে। শিশুর মায়ের কোল তার শিক্ষার হাতে খড়ি। ফলে পরিবার থেকেই শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে।
পরিবার মানব সন্তানের প্রথম শিক্ষা নিকেতন। ছেলে-মেয়েদের জীবনে পারিবারিক শিক্ষার মূল্য অনেক। সন্তানের মূল্যবোধ, আখলাক, চেতনা ও বিশ্বাস জন্ম নেয় পরিবার থেকেই। পিতা-মাতার সঠিক লালন-পালনে সন্তানরা সফল হতে পারে। পিতা-মাতা যে আদর্শ লালন করেন তাদের সন্তানরাও তাই ধারণ করার চেষ্টা করে। এ প্রসঙ্গে নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিলেন : “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও,আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো” । কিংবা কবি গোলাম মোস্তফা বলেছেন- ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। অর্থাৎ একটি শিশুকে সঠিকভাবে বড় করতে হলে পরিবারে মা, বাবার অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জর্জ ওয়াশিংটন বলেছিলেন ‘আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা আমার মা। মায়ের কাছে আমি চিরঋণী। আমার জীবনের সমস্ত অর্জন তারই কাছ থেকে পাওয়া, নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তা আর শারীরিক শিক্ষার ফল।’
অতএব, অভিভাবকদের কর্তব্য হলো শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশ সাধনে ও নৈতিক চরিত্র গঠনে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পালন করা : ১. শিশুর প্রতি যত্নশীল হওয়া, শিশুকে স্নেহ-মমতা, আদর-ভালোবাসা দেওয়া। ২. সদুপদেশ প্রদান করা। ৩. নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষা দেওয়া। ৪. শিশুর চরিত্র গঠনে শিক্ষা দেওয়া। ৫. সৎ কাজের উপদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। ৬. সামাজিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করা ।
আমাদের সমাজে পারিবারিক মূল্যবোধ, অভিভাবকদের প্রতিশ্রদ্ধা প্রদর্শন ও তাদের প্রতি অনুগত থাকা, পারিবারিক ঐতিহ্য ভঙ্গ না করার যে সংস্কৃতি চালু রয়েছে তার পিছনে বড় অবদান কিন্তু পরিবারের। পরিবারের মধ্যে ছেলেমেয়েরা অন্যের সম্পদ, অধিকার ও মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে শেখে, আইনশৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখে। অসৎসঙ্গ ত্যাগ করতে এবং পরিবার ও দেশের প্রতি অনুগত হতে শেখে, তাই দেশজ সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধশীল করে তুলতে পরিবারে রয়েছে বিরাট ভূমিকা। বিদ্যালয় নিঃসন্দেহে এ ধরনের শিক্ষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু পরিবার থেকে যদি শিক্ষাটি আগেই শুরু হয় তা হলে তা এগিয়ে নিতে বিদ্যালয়ের পক্ষে অনেক সহজ হয়। তাছাড়া নৈতিকতা শিক্ষার মতো বিষয়টি শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে পরিবারই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে এবং স্কুলের বাইরে দীর্ঘদিন পরিবার এই দায়িত্ব পালন করে থাকে।
শিক্ষার্থীর পরিবারের আর্থসামাজিক শ্রেণিগত অবস্থান তার আচরণ ও শিক্ষা বিকাশের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম।
শিশুর জীবন বিকাশের সব ক্ষেত্রেই পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবার থেকেই শিশু সব ধরনের পারিবারিক সম্পর্ক সম্বন্ধে প্রথম অবগত হয়। শিশুর মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি কেমন হবে অন্যের প্রতি সে কিরূপ মনোভাব পোষণ করবে এবং কিভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে তা অনেকাংশেই শিশুর পারিবারিক কাঠামো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।
পরিবারে বাবা ও মায়ের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে শিশুরা নারী ও পুরুষের ভূমিকা এবং নিজের লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে অবগত হয়। একক পরিবারের ক্ষেত্রে বাবা ও মায়ের মধ্যে যদি ভালোবাসা ও শৃঙ্খলা বোধের সম্মিলন ঘটে তা হলে পরিবারে একটি সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই ধরনের পরিবার হতে শিশু যে ইতিবাচক অভিজ্ঞতা লাভ করে তা পরবর্তীতে তার সামাজিকি করণের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পরিবার হলো প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা ও মায়া-মমতায় ভরা এমন একটি সুসজ্জিত বাগানের নাম যেখানে প্রতিটি সদস্য তার চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায়। নৈতিক গুণাবলিসমৃদ্ধ হয়ে তারা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সুশোভিত ও মোহিত করে। এটা এমন এক নিরাপদ আবাসস্থল যা বাইরের যাবতীয় পঙ্কিলতা ও আক্রমণ থেকে শিশুসন্তানকে সুরক্ষিত রাখে ।
নৈতিকতা এমন ধরনের উন্নত আচরণ শিক্ষা দেয় যার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে ভালো-মন্দ পার্থক্যবোধের সৃষ্টি হয় এবং যা তাকে সমাজে অধিকাংশের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। সত্যবাদিতা, সাহসিকতা, পরিশ্রমপ্রিয়তা,অনুগ্রহ, সহানুভূতি, সুবিচার, ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য বা সংযম শক্তি, অন্তর্দৃষ্টি, দূরদৃষ্টি, দৃঢ়তা, উচ্চাশা, ভ্রাতৃত্ব, স্বদেশপ্রেম ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলির অন্তর্গত। আর পরিবার থেকেই শুরু হয় নৈতিক শিক্ষার হাতেখড়ি।
রাসূল (সা.) বলেন, তোমাদের সন্তানদের উত্তমরূপে জ্ঞান দান কর, কেননা তোমাদের পরবর্তী যুগের জন্য তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে (মুসলিম)। সুতরাং যদি শৈশবেই তাকে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া হয়, তাহলে সে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। মা-বাবা ও অভিভাবকদের বুঝতে হবে শিশুকাল খুবই অল্প সময়। এ সময় সন্তানের পাশে থাকুন। জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তার সামনে স্পষ্ট করুন। তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে গিয়ে শাসন থেকে একবারে উদাসীন হওয়া যাবে না। আবার শাসনের নামে সীমাতিরিক্ত কিছু করা যাবে না। শৈশবে যারা ভালোবাসা পায় না, নির্যাতন ও ঘৃণার মধ্যে, অবহেলা ও তাচ্ছিল্যের মধ্যে, বাস্তব ঝুঁকির মধ্যে যারা বেড়ে ওঠে; তাদের কারো কারো মধ্যে অপরাধ প্রবণতা থাকে।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই শিশুকে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলে একটি উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে পরিবার এর ভূমিকা অপরিসীম।
লেখক : ব্যাংকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধতবু্‌ও সুস্থ থাকার প্রচেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি