বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত তরুণ সাহিত্যকর্মীদের যে আড্ডার কথা বলেছেন, তেমন আড্ডা এ শহরেও বসত। এ শহরও একদিন মুখরিত ছিল আড্ডাড়ুদের পদভারে। কোলকাতার কফি হাউজের অনুপ্রেরণায় আড্ডা হতো রেস্তোরাঁয়। কফি হাউজের সে–ই আড্ডাটার মতো এ শহরের আড্ডাগুলোও আজ আর নেই। এরা এখন করোটির ভেতরে ঘুমিয়ে আছে রূপকথা হয়ে।
আন্দরকিল্লার চৌরঙ্গি রেস্তোরাঁর আড্ডাটা জমে ওঠেছিল মধ্য সত্তরের দ্রোহী কবি মিনার মনসুরকে কেন্দ্র করে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আড্ডা জমে ওঠত। এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ছড়িয়ে পড়ত। চৌরঙ্গির আড্ডার বিষয় ছিল রাজনীতি। প্রয়াত ছাত্রনেতা বশিরউদ্দিন মাহমুদ, দিলওয়ার চৌধুরীসহ অনেকে হাজির থাকতেন। আমার মতো বিবরবাসীও সে আড্ডায় যোগ দিত বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কর্মসূচি দ্বিতীয় বিপ্লব বাস্তবায়নের বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে।
মিনার ভাই আড্ডাকে জ্ঞানভিত্তিক করার জন্য ‘শেকড়’ নামে ‘পাঠচক্র’ শুরু করেছিলেন। এখানে বঙ্গবন্ধুর দর্শন সম্পর্কে আলোচনা চলত। চৌরঙ্গি আড্ডায় তরুণদের অংশগ্রহণ ছিল বেশি। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে একসময় চৌরঙ্গির দ্বিতীয় তলায় একটা রুম নেওয়া হয়। শেকড় নামে বুলেটিন প্রকাশিত হয়। সমমনাদের কাছে সে বুলেটিন বিক্রি করতাম। শেকড়ের উদ্যোগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রশীদ–আল–ফারুকীর বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হয়েছে। শেকড়ের বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় উপস্থিত থাকতেন অনুপম সেন, মইনুল ইসলাম, রশীদ–আল–ফারুকী, রাণা দাশগুপ্তসহ পণ্ডিতজনরা। বঙ্গবন্ধুর দর্শনকেন্দ্রিক পাঠচক্র একসময় গোয়েন্দাদের নজরে পড়ে যায়। তখন ছিল এরশাদ জমানা। মিনার ভাইয়ের প্রথম কবিতার বই ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে। তাঁর মাথার ওপর ঝুলে আছে সামরিক শাসনের খড়গ। আস্তিনের নিচে ধারালো ছুরি হাতে পিছু তাড়া করছে শিবির নামের রক্তপিপাসুর দল। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ‘শেকড়’র দু’জন সদস্য রাশেদ মনোয়ার, রফিক গ্রেফতার হন। মিনার ভাই ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ’কে সক্রিয় করার নির্দেশ পেয়ে ঢাকা চলে যান। ‘শেকড়’র আড্ডা আর বেশিদিন অব্যাহত থাকেনি। আমরা কে কোথায় ছিটকে পড়ি।
চকবাজারের সবুজ হোটেলে আড্ডা দিতেন হাফিজ রশিদ খান, এজাজ ইউসুফী, খালেদ হামেদী, জিল্লুর রহমান, নিয়ে আলোচনা হতো। এনিয়ে তখন অনেক তর্ক–বিতর্ক হয়েছে। এখান থেকে প্রকাশিত হতো লিটলম্যাগাজিন ‘লিরিক’। আহমেদ খালেদ কায়সার, স্বপন দত্ত, সাথী দাশ, মৃদুল গুহ, ফাউজুল কবীর, অরুণ সেন, আনন্দ মোহন রক্ষিত, রবীন ঘোষ প্রমুখরা নন্দনকাননে সুনীল নাথের দোকানে আড্ডা দিতেন। এদলটা সব–সময় এক জায়গায় আড্ডা দিতেন না। রেয়াজউদ্দিন বাজারের জলযোগে, আন্দরকিল্লার ব্রাক্ষণবাড়িয়া হোটেলে তাঁদের আড্ডা দিতে দেখেছি। যখন যেখানে বসতেন সবাই একসঙ্গেই থাকতেন।
বোস ব্রাদার্সের আড্ডাটা শুরু হয়েছিল আশির দশকে হোসাইন কবিরকে কেন্দ্র করে। বোস ব্রাদার্সে স্বনন আড্ডায় সরব ছিলেন: ইউসুফ রেজা, সাফায়াত খান, হাসান জাহাঙ্গীর, প্রয়াত মুহাম্মদ আলী শাহ, সুবীর কর, সুদীপ্ত দেব, শ্যামা প্রসাদ চক্রবর্তী, বিশ্বজিত চক্রবর্তী, সালাউদ্দিন মো. মারুফ, ম. ই. খান সাজু, শারদ মাযাহার প্রমুখ। হোসাইন কবির ‘ স্বনন’ সম্পাদনা করতেন। সুদীপ্ত ‘ব্যাতিক্রম’, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর সম্পাদনায় ‘বহ্নি’ বের হতো। বহ্নি’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমি, সাজু, ইউসুফ রেজা চিমবুক হোটেলে, রেলওয়ে স্টেশনের কেন্টিনে, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীর নালাপাড়ার বাসায়, সেন্ট প্লাসিড স্কুলে আড্ডা জমাতে চেয়ে সফল হইনি।
এ শহরের পুরাতন আড্ডাগুলোর একটি অচিরা পাঠচক্র। এটা ফুলকিতে বসত। আবুল মোমেন ছিলেন এর প্রাণপুরুষ। তখন তরুণ তুর্কী কবি–ছড়াকারদের একটি অংশ এখানে আসতেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ওমর কায়সার, ইব্রাহিম আজাদ, সনতোষ বড়ুয়া, উত্তম সেন। এখানে সাহিত্যবিষয়ক আলোচনা হতো বেশি। মোমেন ভাই ‘অচিরা’ লিটলম্যাগাজিনটি সম্পাদনা করতেন। অচিরা পাঠচক্রের একটি স্মরণীয় নাম শিল্পী অচিন্ত্য আইচ।
অরুণ দাশগুপ্তের বাসায় সপ্তাহের সাতদিনই দিবা–রাত্রি আড্ডা চলত। বুধবার সন্ধ্যার আড্ডাটা ছিল বিদগ্ধজনদের। এসময় আসতেন অনুপম সেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, আবদুল হক চৌধুরী, চৌধুরী জহুরুল হক, সুখেন্দু ভট্টাচার্য, খুরশীদ আনোয়ার। বুধবার সন্ধ্যায় প্রবীণদের সরব উপস্থিতির কারণে আমরা তরুণরা ভিড়তাম না। অক্ষোকৃত প্রবীণ কমলেশ দাশগুপ্ত, আশীষ সেন, প্রদীপ দেওয়ানজী, জ্যোতির্ময় নন্দী, শাহীদ আনোয়ার, অজয় দাশগুপ্ত উপস্থিত থাকতেন। অন্যসময় নবীণ–প্রবীণ সব বয়সীদের অবাধ যাতায়াত ছিল। এখানে সাহিত্য–সংস্কৃতি–রাজনীতি–অর্থনীতি সব বিষয়ে আলোচনা হতো। তুমুল বাদ–প্রতিবাদ হতো। কখনও এসব বাদ–বিবাদের মীমাংসা হতো, কখনও হতো না। কখনও পরের দিনের জন্য তুলে রাখা থাকত। অরুণ দাশগুপ্ত, খুরশীদ আনোয়ার সম্পাদিত ‘আপাতত’ ছিল বুধবারের আড্ডার একটি ফসল।
স্বকালের আড্ডাটা ছিল অনেকটা আনুষ্ঠানিক। রাশেদ রউফের নেতৃত্বে আশির দশকের মধ্যভাগে একদল শিশুসাহিত্যিক লালদিঘির পাড়ে, কখনো রঙ্গম সিনেমা হলের পাশে আবদুর রহমান স্মৃতি পাঠাগারে, কখনও বুড্ডিস্ট ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে বসতেন। তাঁরা নিজেদের লেখা পাঠ করতেন। পাঠোত্তর আলোচনা করতেন। স্বকাল সাহিত্য আসরে আমিও যেতাম। স্বকালের শততম আসর অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯১ সালে জেলা পরিষদ মিলনায়তনে। দৈনিক ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরের পরিচালক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। রাশেদ রউফ স্বকাল নামে একটি লিটলম্যাগ বের করতেন। স্বকালের ধারাবাহিকতায় আসে শৈলীর আড্ডা। মধ্য নব্বইয়ে শিশুসাহিত্যিকদের একটা অংশ নিয়মিতভাবে একত্রিত হতেন শৈলী’র আড্ডায়। এ আড্ডা নিয়ে দৈনিক মুক্তকন্ঠ পত্রিকায় চমৎকার একটা ফিচার প্রকাশিত হয়েছিল। শৈলী প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ সিরু বাঙালির ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার : ইতিহাসের নিষিদ্ধ সংলাপ‘।
নব্বই দশকের শুরুতে আমাদের নন্দনে বসত জমজমাট আড্ডা। এখানে শিল্প–সংস্কৃতি–রাজনীতি সব ধরনের মানুষেরা আসতেন। আড্ডা দিতেন। যেদিন যে ঘরণার মানুষের উপস্থিতি বেশি থাকত সেদিন সে বিষয়ে আড্ডা চলত। নন্দনের আড্ডার বিশেষত্বটা ছিল এটা এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মুক্তমনের মানুষেরা এখানে আসতেন। ক্ষাণিকক্ষণের আড্ডায় ঝড় তুলতেন। চট্টগ্রামে শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে যে বিভক্তি ছিল, তার কোনো প্রভাব ছিল না এখানে। নন্দনের প্রভাবশালী আড্ডাড়ুদের মধ্যে ছিলেন শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, অজয় দাশগুপ্ত, ইয়াকুব ভাই, আবদুল হালিম দোভাষ, মাহাবুব আলতামাস, স্বপন সরকার, জহিরুল ইসলাম, কালাম চৌধুরী, প্রদীপ খাস্তগীর, মাহাবুব হাসান, সুখেন্দু ভট্টাচার্য, এম. ইদরিস আলম, পারভেজ চৌধুরী, আহমেদ ইকবাল হায়দার, ম. সাইফুল আলম, পীযুষ দস্তিদার, পঞ্চানন চৌধুরী, অঞ্চল চৌধুরী, দেওয়ান মাকসুদ। নন্দনের অংশীজনরাও নীরবে, সরবে উপস্থিত থাকতাম এ আড্ডায়। অকাতরে তরুণ লেখক–সংস্কৃতি–নাট্যজনরা আসতেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তো বটে, কখনও দিনেরবেলায়ও তুমুল আড্ডা জমত। পহেলা বৈশাখ, বিজয় মেলার প্রাক্কালে বসবার স্থান–সংকুলান হতো না। অচিরেই নন্দনের আড্ডার খবর ঢাকা–চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে।
পত্র লেখক–লেখিকা গোষ্ঠী’র (পলগ) সদস্যরা আড্ডা দিতেন সার্কিট হাউজ মাঠের সবুজ চত্বর, ফয়েজ লেক, বুড্ড্ষ্িট ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে। পলগের কয়েকজনের নাম এখনও মনে আছে– নুরুল আবছার, ফরিদা ফরহাদ, সরওয়ার হোসেন নবাব, নোমান লিটন, সাঈদুল আরেফীন। জাপলেসের ছিল পৃথক আড্ডা। ‘জাপলেস’র আগে হয়েছিল ‘চপলেস’। এর প্রতিষ্ঠাতা এম.এ.গফুর, রামবাবুর্চ্চি পুকুরপাড়, কোরবানীগঞ্জ, চট্টগ্রাম– ঠিকানায় পত্র–পত্রিকায় বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিঠিপত্র লিখে বেশ পরিচিতি লাভ করেছিলেন। হাজার শব্দের উপসম্পাদকীয় লিখে সে পরিচিতি অর্জন এখন অসম্ভব। তখন দৈনিক পত্রিকার চিঠিপত্র কলাম খুব জনপ্রিয় ছিল। তাঁদের লেখালেখির কারণে অনেক নাগরিক সমস্যার সমাধান হয়েছে। দৈনিক আজাদী এক অনুষ্ঠানে নিরবচ্ছিন্ন চিঠিপত্র লেখালেখির জন্য এম.এ.গফুরকে সম্মানিত করেছে। তাঁর সে আড্ডায় ছিলেন মতিলাল দাশ, অরুণ শীল, রমজান আলী মামুন প্রমুখ।
আন্দরকিল্লা গুডেনবার্গ প্রেসে আড্ডা দিতে যেতেন অচিরার আড্ডাড়ুরা। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন– প্রলয় দেব, সেলিনা শেলী, সাফায়েত খান, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ওমর কায়সার, ইব্রাহিম আজাদ, শাহিদ আনোয়ার, আবু মুসা চৌধুরী, জ্যোতির্ময় নন্দী। কোতোয়ালী সাধুর মিষ্টির দোকানে বসতেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পথনাটক রচয়িতা মিলন চৌধুরী। ষোলশহর দুই নম্বর গেইটে বিশ্বদ্যিালয় ক্লাবে আড্ডা দিতেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, বিশেষ করে যাঁরা চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করতেন। ক্যাম্পাস থেকেও অনেক শিক্ষক আসতেন। শিল্পকলা একাডেমী, মুসলিম হলের আঙ্গিনায় নাট্যকর্মীরা, প্রেসক্লাবে সাংবাদিকরা নিয়মিত আড্ডা দিতেন। তখন পার্টি অফিসগুলোতেও রাজনৈতিক আড্ডা চলত। বাংলা হোটেল, হাজারী লেইন, ডিসি হিলের খোলা প্রান্তরে আড্ডা বসত। ‘এখন এসব কল্পকথা, দূরের শোনা গল্প, তখন সত্যি মানুষ ছিলাম, এখন আছি অল্প’। সব আড্ডার কথা লিখতে পারিনি। সব আড্ডাড়ুর কথাও বলা হয়নি। অপূর্ণতাটুকু তোলা থাকল অন্যকোনো গবেষকের জন্য।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যজন, প্রাবন্ধিক।