এবারের বন্যায় ক্ষতি ১ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল

চট্টগ্রাম কৃষি অঞ্চল সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান কৃষকদের দেশের কৃষি উৎপাদনসহ খাদ্য নিরাপত্তায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে

হাসান আকবর | শুক্রবার , ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় কৃষি সেক্টরে মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যা দেশের কৃষি উৎপাদনসহ খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। জমিতে লাগানো আমন ধান পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে বীজতলাও। আবার নতুন করে বীজতলা তৈরি করে চারা গজিয়ে চাষাবাদ করা আদৌ সম্ভব হবে কিনা তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, চট্টগ্রামের কৃষি অঞ্চলে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালীসহ ৫টি জেলা, ৪২টি উপজেলা ও ৩টি মেট্রোথানার সমন্বয়ে গঠিত। ১৪ হাজার ৪ শত ২৩ দশমিক ২২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বিস্তৃত এই অঞ্চলে প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। অত্র অঞ্চলের প্রধান ফসল ধান। এছাড়া চা, ভূট্টা, গোলআলু, বাদাম, তরমুজসহ বিভিন্ন ফলমূল ও শাকসব্জী উৎপাদিত হয়। ফেনী ও কক্সবাজার জেলা মূলত ধান উৎপাদন এলাকা। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, ফটিকছড়ি অঞ্চলেও প্রচুর ধানচাষ হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম খাদ্য ঘাটতির একটি অঞ্চল। এখানে প্রচুর বাইরের লোকের বসবাস হওয়ায় এই অঞ্চলটিতে খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। যা দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে এনে যোগান দিতে হয়।

চট্টগ্রামে ধানচাষের একটি বড় অংশ দখল করে থাকে আমন। প্রচুর ফলন আসে এই মৌসুমের চাষ থেকে। কৃষকেরা তাদের জমিতে একটু আগেভাগে আমন লাগিয়ে দ্রুত ফসল ঘরে তুলতে চান। এবারও প্রচুর জমিতে আমনের চাষ হয়েছিল চট্টগ্রাম কৃষি অঞ্চলের এলাকাগুলোতে।

চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, হাজার হাজার একর আমন চাষ সম্পন্ন করে কৃষকেরা উৎসবমুখর ভাবে ঘরে ফিরলেন, তখনই ভয়াল বন্যা সব তছনছ করে দিল।

শুধু চট্টগ্রামেই প্রায় ৫শ’ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, আসলে টাকার অংকে এই ক্ষতি নিরুপন করা যাবে না। ফসল প্রাপ্তি নিয়ে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হলো তা সামাল দেয়া কঠিন হবে। তিনি বলেন, একজন কৃষক তার সর্বস্ব খরচ করে চাষাবাদ করলেন। তা ধ্বংস হয়ে গেল। এখন নতুন করে আবার চাষ করার মতো অবস্থা ওই কৃষকের নেই। হয়তো দেখা যাবে জমিটি খালি পড়ে রয়েছে। কোন ফসলই ওই জমি থেকে এই মৌসুমে আর পাওয়া যাবে না। এই ক্ষতির প্রভাব ব্যাপক বলেও তিনি মন্তব্য করেন। কৃষি বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম কৃষি অঞ্চলে এবারকার বন্যায় সর্বমোট ১ লাখ ৫৩ হাজার ১০৩ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে অনেক জমিই খালি পড়ে থাকবে বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উল্লেখ করেন।

কৃষি বিভাগের কাছ থেকে প্রাপ্ত হিসেব মতে, সীতাকুণ্ড, মীরসরাই, ফটিকছড়ি, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও বাঁশখালী উপজেলার ধানী জমিতে বন্যা মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলেছে। উক্ত সাত উপজেলায় বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ১ হাজার ৯২২ হেক্টর সবজি বাগান। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ ও আমন খেত। আমন ধানের উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রায় অর্জিত না হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করে কৃষি অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, টাকার অংকে চট্টগ্রামে আমনের ক্ষতি ২৫২ কোটি টাকা উল্লেখ করে সরকারের কাছে রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই ক্ষতি অপূরণীয় বলেও তারা মন্তব্য করেছেন।

চট্টগ্রামের একজন কর্মকর্তা মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমনের ক্ষয়ক্ষতি এতো ব্যাপক হয়েছে যে বহু কৃষকই নিঃস্ব হয়ে গেছেন। চট্টগ্রাম জেলায় এবার ১ লাখ ২ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়। এর মধ্যে বন্যায় তলিয়ে গেছে ৪৩ হাজার ৫শ হেক্টর জমির ফসল। তলিয়ে যাওয়া আমন ক্ষেতের মধ্যে ১৩ হাজার ৮৩১ হাজার হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চট্টগ্রামে এই বন্যায় মোট ১ লাখ ৬১ হাজার ৩৭১ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাদের অনেকেরই আর চাষাবাদ করার মতো সামথ্য নেই।

আবার চলতি মাসেই আউশ ধান ঘরে তোলার কথা ছিল কৃষকদের। কিন্তু বন্যায় তাও নষ্ট করে দিয়েছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় ৩৩ হাজার ১ হেক্টর জমিতে আউশের চাষ হয়েছিল। এরমধ্যে ৮ হাজার ৩৮৩ হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে কোটি কোটি টাকার ফসলহানী হয়েছে বলেও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

চট্টগ্রামে আমন এবং আউশ ধানের যে ক্ষতি হয়েছে তা খাদ্য ঘাটতির এই জেলাটিতে মারাত্মক রকমের প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করে বলা হয়েছে, এই ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের বেশ বেগ পেতে হবে।

সীতাকুণ্ডের জাফর নগর গ্রামের কৃষক মদিন উল্ল্যাহ দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমি প্রায় দুই একর জমিতে আমন চাষ করেছিলাম। সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর চারা নেই যে নতুন করে লাগাবো। তিনি চারদিকের সব বীজতলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চারার ভয়াবহ অভাব দেখা দিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সরকার বিশেষ কোন উদ্যোগ নিয়ে আমাদের পাশে না দাঁড়ালে নতুন করে চাষাবাদ করে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। তিনি সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবদুচ ছোবহান দৈনিক আজাদীকে বলেন, ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক। তবে আমরা কিছুটা আশাবাদী যে, চট্টগ্রামে আমন ধান কিছুটা দেরিতে লাগানো হয়। আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমন লাগানো যাবে। তবে চারার যেই সংকট তা কাটিয়ে উঠা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে শহীদী মার্চে ছাত্র-জনতার ঢল
পরবর্তী নিবন্ধচসিকের দুই কাউন্সিলরসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা