রাঙ্গুনিয়ায় আগুনে এক পরিবারের ৫ জন মারা যাওয়ার ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসসহ এলাকাবাসী ধারণা করছে, রান্নার চুলা থেকে বসতঘরে আগুন লেগেছে। তবে তা মানতে নারাজ এই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া পরিবারের একমাত্র সদস্য খোকন বসাক। তিনি বলছেন, চুলা থেকে নয়, বরং কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এটা শতভাগ নিশ্চিত বলে উল্লেখ করেন তিনি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন খোকন বসাক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই দাবি করেন। তবে ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয়রা দাবি করেন, চুলা থেকেই আগুন লেগেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনও বলছেন একই কথা। প্রমাণ হিসেবে সিসিটিভি ফুটেজ দেখান।
চোখের সামনে দুই সন্তান, মা-বাবা ও স্ত্রীকে হারিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছেন পরিবারের ছয় সদস্যের মধ্যে বেঁচে যাওয়া খোকন বসাক। তার বাম হাত, বুক, পিঠ ও মুখের একাংশ পুড়ে গেছে। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে তার স্বজনরা জানিয়েছেন, খোকন এখন আশঙ্কামুক্ত।
হাসপাতালে খোকন সাংবাদিকদের বলেন, সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। রাত ৮টার আগে রান্না শেষ। এরপর প্রতি সপ্তাহের ন্যায় বাড়ির পাশের মন্দিরে কীর্তন অনুষ্ঠানে পরিবারের সবাই যায়। সেখান থেকে ফিরে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এর মধ্যে দেখি মা কয়েকবার বাথরুমে গেছেন। মায়ের পেটে অসুখ হয়েছে ভেবে বাসায় থাকা ডাব কেটে খাওয়ানোর জন্য দা আনতে চুলার কাছে গিয়েছিলাম। তখনো আমি দেখেছি, রান্নার লাকড়ি, পাতা এসব চুলা থেকে অন্তত চার ফুট দূরে আছে। চুলার উপর ছিল গরম পানির হাঁড়ি। সেজন্য বলছি, এটা চুলার আগুন হবে না।
তিনি বলেন, এবার প্রথম নয়, আরো দুইবার আমার ঘরে আগুন লেগেছিল। প্রথমবার আমার বিয়ের সময়। তখন সবাই যখন শহরে আমার শ্বশুরবাড়ি যায়, আমার বিয়ের গেট আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ৪/৫ বছর আগেও আগুন লেগে আমার বেড়ার ঘরটি পুড়ে গেছে। তখনো সবাই বলেছে, এটি চুলার আগুন ছিল।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে খোকন বসাক বলেন, রাত ১টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন লাগে। আমার দুই সন্তান ও আমার মা রান্নাঘরের পাশের রুমে থাকতেন। আগুন লাগার খবর তারা আগে জানতে পারে। পরে বাবা ‘আগুন আগুন’ বলে আমাদের ডাক দেন। পরে তাদের সাথে নিয়ে দরজা খুলি। এ সময় আগুন সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের মধ্য দিয়ে আমি বের হতে পারলেও তারা ভয়ে বের হতে পারেনি। তখন আমার গায়ে আগুন জ্বলছিল। সেই আগুনে তারা পুড়ে মারা গেছে। আমি শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, এটা রান্নাঘরের আগুন না। কেউ লাগিয়ে দিয়েছে।
খোকনের এমন বক্তব্যের সূত্র ধরে গতকাল দুপুরে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার উত্তর পারুয়া মহাজনপাড়ায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্রাহ্মণ সংসদ রাঙ্গুনিয়া উপজেলা শাখার উদ্যোগে খোকন বসাকের স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের আদ্যশ্রাদ্ধ ক্রিয়া চলছে। মা-বাবার আদ্যশ্রাদ্ধ ভারতে বসবাসরত খোকন বসাকের বাকি দুই ভাই করছেন বলে জানা যায়। ঘরের ভেতরে নীরবতা। পোড়া গন্ধ নাকে আসছে। ঘরের পুড়ে যাওয়া সামগ্রী, এমনকি সিএনজি টেঙিটিও আগের জায়গায় পড়ে রয়েছে।
শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের পাশে কান্নায় ভেঙে পড়েন খোকন বসাকের বড় বোন অঞ্জনা দে। ভাইয়ের বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, সিসিটিভিতে যা দেখা যাচ্ছে তাই হবে। আমরা তো ঘটনাস্থলে ছিলাম না। আগেও দুবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে-এটা সত্য। এটি যদি কেউ লাগিয়ে দিয়ে থাকে, তা উদঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।
ছোট বোন প্রতিবেশী ত্রিদিব বসাক বলেন, এটি চুলার আগুন থেকেই লেগেছে। কারণ হিসেবে তিনি হাতে থাকা মোবাইলে সিসিটিভি ফুটেজ দেখান। তারপরও খোকন যেহেতু বলছে, সেটি যেন খতিয়ে দেখা হয়।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান একতেহার হোসেন বলেন, খোকন বসাক অসুস্থতার মধ্যে হয়ত ভুল বুঝছেন। তবে চুলা থেকে লেগেছে এটি অনেকটা নিশ্চিত। কারণ সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে এমন দৃশ্য। তারপরও খোকন বসাকের কথার সূত্র ধরে সিসিটিভি ফুটেজ প্রশাসনকে দেয়া হয়েছে, যাতে তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখতে পারে।
রাঙ্গুনিয়া থানার ওসি মো. মাহবুব মিলকী বলেন, সিসিটিভি ফুটেজগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মন্দিরের ওইদিকে তার রান্নাঘরের চুলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তারপরও আমরা বিষয়টা খতিয়ে দেখছি।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে পারুয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মহাজনপাড়ায় অগ্নিকাণ্ডে একই পরিবারের ৫ দগ্ধ হয়ে মারা যান। তারা হলেন খোকন বসাকের বাবা কাঙ্গাল বসাক, মা ললিতা বসাক, স্ত্রী লাকি বসাক, ছেলে সৌরভ বসাক ও মেয়ে সায়ন্তী বসাক।
উপজেলা চেয়ারম্যানের সহায়তা : গতকাল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান স্বজন কুমার তালুকদার। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অগ্নিদগ্ধ খোকন বসাকের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা প্রদান করেন।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আকতার হোসেন খান, উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক মো. কামাল উদ্দিন চৌধুরী, পারুয়া ইউপি চেয়ারম্যান একতেহার হোসেন ও পংকজ চক্রবর্ত্তী।











