ফেসবুকীয় জীবনে এখন নতুন সংযোজন রিল্স, কয়েক সেকেন্ডে সমস্ত দুনিয়াকে তুলে আনা। অবসর সময়ে ফেসবুকের স্ক্রলিং নিত্য বিষয়। কিন্তু বিনোদনের মধ্যেও অনেক জটিল বিষয় চোখে পড়ে। এক বান্ধবী খুব ঠাট্টা করেই রিল্স শেয়ার দিয়েছে, মূল বিষয় একজন পুরুষ, তার বান্ধবীর কাছে জানতে চায়, আমরা না থাকলে তোমাদেরকে কে রক্ষা করবে? অট্টহাসিতে বান্ধবী উত্তর দিলো, তখন আর কাদের থেকে রক্ষা করতে হবে আমাদের?
প্রচণ্ড হেসেছি, ভাবছি আসলেই তো পুরুষই যদি না থাকে, নারীকে আর রক্ষা করার বিষয়টিই থাকবে না হয়তো। কিন্তু যুক্তিবিদ্যার কাছে এই উত্তর হয়তো পছন্দ হয়নি। আদতে পুরুষের চিরতরে প্রস্থানই কি সকল সমস্যার সমাধান? বা মূল সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং তার সমাধানে আমরা সক্রিয় নই।
মাথা ব্যথা করলে যেমন মাথা কেটে ফেলি না, তেমনই নিপীড়কের কারণে সমস্ত পুরুষ জাতিকে উপড়ে ফেলার কথা তো নয়। নিপীড়ক যে– কেউ হতে পারেন, অন্যায় এবং অন্যায়কারীর নির্দিষ্ট লিঙ্গ নেই। তবে দীর্ঘ সময় ধরে পুরুষদের দ্বারা যে নির্যাতন, নিপীড়ন, পুরুষতন্ত্রের শিকার হচ্ছি আমরা, তার সুরাহা কোথায়।
লেখাটার মূল উদ্দেশ্য আপাতত এই সুরাহার দিকে কোনো ইঙ্গিত দিতে পারছে না বলে, দুঃখ প্রকাশ করছি। রিল্সের এই ঘটনা উল্লেখ করার একমাত্র কারণ উন্মুক্ত নিপীড়কের প্রতি দৃষ্টিপাত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর ১৭ জুলাই একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণের ভিতরে রাতের বেলা বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ ও নির্যাতন করা হয়। সে ঘটনার পাঁচ আসামীর বিচার চেয়ে বিপুল আন্দোলন হয় এবং র্যাব তাদেরকে গ্রেফতার করে। ঘটনার এতদিনের মাথায় সেই নিপীড়িত শিক্ষার্থীর অবস্থা খুব বেশি উন্নত হয়েছে বলা যাচ্ছে না। কেননা সমস্ত ঘটনা তার কাছে এখনো দুঃস্বপ্নের মত। নিজের মানসিক পরিস্থিতি সামলিয়ে হয়তো উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলো সে কিন্তু তার মধ্যেই নিপীড়কেরা উন্মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকেই জুস বারের ব্যবসায় মেতে উঠেছেন তারা। তাদের কয়েকজনকে জুস বারের ভেতরেই উপস্থিত দেখা যায়। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আরো বলছেন, জুসবারে আসামীদের দেখে সে আতঙ্কে ছিল, তখন জুস বিক্রি করতে গিয়ে তাদের একজন বাকি ক্রেতাদের চিনিয়ে দিচ্ছিলো, এটিই সেই মেয়ে যার ভিডিও করছে… এছাড়াও নানাভাবে উত্ত্যক্ত করছিলো এবং হুমকি দিচ্ছিলো।
ভাবুন তো? আমাদের কাদের থেকে রক্ষা করতে এই ছুটে চলা? নিজের মানসিক পরিস্থিতি যেখানে চরম অবনতিতে, দিনের পর দিন সেই দুঃস্বপ্নের তাড়া, সেখানে চোখের সামনে নিপীড়কদের ঘুরে বেড়ানো কতটা আতঙ্কের? এই আতঙ্ক কি শুধু সেই ভুক্তভোগীর? নাকি বাদবাকি নারী শিক্ষার্থীদের জন্যে নিরাপত্তাহীনতার প্রতি ভিন্ন বার্তা।
যখনই স্টেশনের সেই রাস্তা পার করি, বারবার চোখ যায় জুসবারে, শনাক্ত করার চেষ্টা করি আসামীদের, কখনো ভয়ে চুপসে যাই, আর ভাবতে থাকি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের এত অধঃপতন কি আর ঠেকানো যাবে!
রিল্সের সেই নারীর কথা মনে পড়ে, পুরুষেরা না থাকলে আর কাদের থেকে রক্ষা করতে হবে আমাদের?
প্রতিদিন ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা,গুমসহ নানান ক্ষেত্রে নারীদের উপর পুরুষদের এই নির্যাতন দেখতে–দেখতে অন্যায়কারীর লিঙ্গ যেন পুরুষই হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের কাছে। কিন্তু লিঙ্গের ভেদাভেদ ভুলে আমার যে বন্ধুর সাথে রোজ একই ক্লাসে বসি, আড্ডা দি, কিংবা ভুক্তভোগীর পুরুষ বন্ধুরা, অথবা দুনিয়ার সকল পুরুষ প্রেমিকরা যারা এসবের ঊর্ধ্বে, এক কাপ চায়ের সাথে অথবা পাশে এসে সবচেয়ে ভালো মানুষ রূপে ধরা দেয় তাদেরকে কি উপড়ে ফেলা যায়?
তাদের হয়তো উপড়ে ফেলা যায় না, কিন্তু কোথাও যেন সংকোচ–ভয়, দুশ্চিন্তা প্রত্যেক নারীর মনেই থেকে যায়। তাই অবচেতন মনে বলে ফেলি, তোমরা না থাকলেই বা কি, রক্ষাই যেন পাই।
উন্মুক্ত নিপীড়ক, প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার চরম নাম। প্রশাসন আন্দোলনের তোপের মুখে আসামীদের গ্রেফতার করলেও আসামীরা জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আসামীদের জামিন, প্রশাসনের চোখের বাইরে নয়। কিন্তু সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জুসবারের মত ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছেন আসামীরা, এটি নির্দেশ করে কারো অগোচরে নয় বরং উন্মুক্তভাবেই নিজেদের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ করতে এই অবতার।
বর্তমানে ভুক্তভোগী নিজের জীবন বাজি রেখে পড়াশোনা করতে হিমশিম খাবেন নিশ্চিত, পরিবার থেকে এতটা সাহস কেউ দেখাবে না হয়ত। আর আমাদের তথাকথির পরামর্শদাতারা এখন আরো উদ্গ্রীব হয়ে বাসায় বসে থাকার নির্দেশ দিলে খুব একটা দোষের হবে না। এর বাইরে যে নারী শিক্ষার্থীরা আছেন? তাদের মাথার উপর ঘণ্টার মত বার্তা দেবে, তুমি নিরাপদ নও, তোমাকে রক্ষা করতে হবে, সাবধান থাকতে হবে সর্বত্র। কাল পরশু তোমার সাথেও এমন ঘটতে পারে, ঘটলে বিচার পাবে না আর বিচারের নামে মশকরা করলেও আসামীরা আবার ফিরে আসবে। সকল বাঁচার রাস্তা বন্ধ করে একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বেমালুম টিকে থাকবে!
টিকে থাকাটা সহজ এখানে, একটু আপস করলেই হবে হয়তো। অথবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সন্ধ্যার পরে নারী শিক্ষার্থীদের যাতায়াত বন্ধ করে দেবেন, এরচেয়ে কি ভালো হয় নারী শিক্ষার্থীদের আগমনই বন্ধ করে একচেটিয়া শাসন করলে? তাহলে হয়তো দিনে–দুপুরে হেনস্থার আশঙ্কা পুরোপুরি কমানো যাবে!
উচ্চ বিদ্যাপীঠে না হয় নারী শিক্ষার্থীদের আগমন বন্ধ করা যাবে। কিন্তু খুব ছোট শিশুদের যাদেরকেও লিঙ্গের দোষে ভুগতে হয়, যাদের মা বাবারা ঘরে–বাইরে আতঙ্কে থাকেন অথবা বিদ্যালয়ে ভুলেও একলা পাঠান না, সকলের সমাগম না হলে ঐ বিদ্যালয় নামক গুমট কক্ষে একলা রেখে আসতে ভয় পান। তাদের কি হবে? তাদের জন্যে সমাধান কি!
বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত আসামীরা একটি নমুনা কেবল। তাদের চোখে পড়ছে কারণ তাদের কৃতকর্মের আমরা সাক্ষী। তবে যেসব উন্মুক্ত খারাপ স্পর্শ, চোখে–মুখে ঘুরে বেড়ানো ধর্ষক, যাদেরকে এখনো চেনা হয়নি, অগোচরে রয়ে গেছেন, কুকর্ম করে পালিয়ে গেছেন, যাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়নি তাদের থেকে মুক্তি কি আদৌ মিলবে? তাদের থেকে রক্ষা করবে কে?
কষ্ট পেতে হয়, যখন সমস্ত লেখায় প্রশ্নবোধক চিহ্নের ছড়াছড়ি থাকে। কিন্তু বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই, রক্ষা করার এই যুদ্ধে এখন সকলে ক্লান্ত। পুরুষেরা দিনে দিনে মস্ত বড় হায়েনা রূপে ধরা দিচ্ছে, আর তাদের খাদ্য শক্তিশালী প্রশাসন, নেতা, বড় ভাই ইত্যাদি… এসব গিলে খেয়ে পাকস্থলিতেই গাঁজন করছে। তরল জুস রূপে সমস্ত শরীরে উদ্দীপনা চরমে তুলেছে। আর ঐ যে ‘ডাইস’ রূপে তো নারীরা আছেই।
অন্ধকার থেকে মুক্ত হতে প্রশাসন নামক এই জঞ্জাল থেকেই মুক্তি বোধহয় প্রথম শর্ত। কোনো শাসন–বিচার বিভাগের হাত না ধরে, নিজেদের রক্তে জ্বালানো বহ্নিশিখাই পারে উন্মুক্ত সকল নিপীড়কদের দুমড়ে–মুচড়ে দিতে।