সারা বিশ্বের মুসলিমদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে যা বারবার ফিরে আসে। মুসলমানদের জীবনে অপার আনন্দের বার্তা নিয়ে বারবার ঈদ আসে। ফিতর মানে ভঙ্গ করা। পবিত্র রমজান মাসের সিয়াম আদায়ের পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিন সকালে সিয়াম ভঙ্গ করে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ উৎসব করা। এটিকে রোজার ঈদও বলা হয়। দরজায় কড়া নাড়ছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। চারদিকে যেন আনন্দের বন্যা বইছে। পশ্চিমাকাশে ঈদের চাদ উঁকি দিলেই এ আনন্দ পূর্ণ মাত্রা পাবে। কিন্তু ঈদের রাতটি (চাঁদ রাত) অবহেলার রাত নয়। ইসলামে যে রাতগুলো ইবাদতের জন্য এবং ফজিলতে পরিপূর্ণ সেসবের অন্যতম এই ঈদের রাত। চাঁদরাতের প্রথম সুন্নত ও ফরজে কিফায়া আমল হলো সূর্যাঁস্েতর সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ দেখা। চাঁদ দেখলে বা চাঁদ দেখার সংবাদ নিশ্চিত হলে দোয়া পড়া সুন্নত। নতুন চাঁদকে আরবিতে বলে হিলাল। হিলাল হচ্ছে এক থেকে তিন তারিখের চাঁদ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো, চাঁদ দেখে রোজা ছাড়ো, ইফতার করো বা ঈদ করো। যে সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ দেখা যায় সে রাত হলো চাঁদরাত। আরবি চান্দ্র বছরের নবম মাস রমজান এবং দশম মাস শাওয়াল। রমজানের রোজার শেষে পয়লা শাওয়াল ঈদুল ফিতর বা রমজানের ঈদ। শাওয়ালের চাঁদরাত হলো ঈদের রাত। শাওয়ালের চাঁদরাত তথা রমজানের ঈদের রাতের আমল হলো : পুরুষদের মাগরিব এশা ও ফজর নামাজ মসজিদে জামাতের সঙ্গে পড়ার চেষ্টা করা এবং নারীদের আউওয়াল ওয়াক্তে ফরজ নামাজ আদায় করা। রাতের ইবাদতের জন্য বিশেষভাবে পবিত্রতা অর্জন করা ; সম্ভব হলে গোসল করা। ইবাদতের উপযোগী ভালো কাপড় পরিধান করা। মাগরিবের পর আউওয়াবিন নামাজ পড়া এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া। রাত জেগে নফল ইবাদত করা। নফল নামাজ পড়া। তাহ্যিয়াতুল অজু,দুখুলুল মাসজিদ,তাওবার নামাজ, সলাতুল হাজাত,সলাতুত তাসবিহ, সলাতুশ শোকর ইত্যাদি পড়া। কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করা, সুরা ইয়াসিন, সুরা রহমান, সুরা ওয়াকিআ, সুরা মুলক, সুরা মুজাম্মিল, সুরা মুদ্দাচ্ছির, সুরা ফাতহ, সুরা নাবা ইত্যাদি পাঠ করা। দরুদ শরিফ পাঠ করা, ইঁস্িতগফার করা, তাসবিহ তাহলিল, জিকির আসকার ইত্যাদিতে মশগুল থাকা।
মহান আল্লাহ এই রাতকে বিশেষভাবে মহিমান্বিত করেছেন। মুয়াজ (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন যে ব্যক্তি পাঁচ রাত জেগে থাকবে তার ওপর জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। রাতগুলো হলো–১৫ শাবানের রাত, ঈদুল ফিতরের রাত, ৮ জিলহজের রাত, ৯ জিলহজের রাত ও ঈদুল আজহার রাত। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন যে দুই ঈদের রাতে সওয়াবের নিয়তে ইবাদত করবে তার অন্তর সেদিন মরবে না যেদিন অন্যদের অন্তর মরে যাবে। মুসলমানদের ধর্মীয় দুটি উৎসব : ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার প্রবর্তন হয় দ্বিতীয় হিজরি সনে। এবছরই বদরের বিজয়ের ১৩ দিন পর পয়লা শাওয়াল ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করা হয় এবং মদিনার সুদখোর মহাজন ইহুদি বনু কাইনুকা সম্প্রদায়কে নিরস্ত্র করার পর ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালন করা হয়। নবীজি (সা.) বলেন প্রতিটি জাতির উৎসব আছে আমাদের উৎসব হলো এই দুই ঈদ (মুসলিম, তিরমিজি)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন যখন ঈদের দিন তথা ঈদুল ফিতরের দিন আসে তখন আল্লাহ বান্দাদের বিষয়ে ফেরেশতাদের সঙ্গে গর্ব করেন। বলেন হে আমার ফেরেশতারা! যে শ্রমিক তার কর্ম পূর্ণ করেছে তার বিনিময় কী? তারা বলবে তাদের বিনিময় হলো তাদের পারিশ্রমিক পরিপূর্ণরূপে প্রদান করা। বলবেন হে আমার ফেরেশতারা! আমার বান্দাবান্দীরা তাদের দায়িত্ব–কর্তব্য পালন করেছে তারপর দোয়ার উদ্দেশে বের হয়েছে। আমার সম্মান, মহত্ত্ব, করুণা, মাহাত্ম্য ও উচ্চ মর্যাদার শপথ! আমি তাদের প্রার্থনা গ্রহণ করব। এরপর আল্লাহ বলবেন তোমরা ফিরে যাও আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমাদের মন্দ আমলগুলো নেকিতে পরিবর্তন করে দিলাম। নবীজি বলেন তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে যাবে। ঈদের নামাজ পড়া পুরুষদের জন্য ওয়াজিব। ঈদের নামাজের সময় হলো সূর্যোদয়ের পর থেকে মধ্য দিবসের পূর্ব পর্যন্ত। ঈদের নামাজের আগে বা পরে কোনো নফল নামাজ পড়া যায় না। ঈদের নামাজের জন্য আজান ও ইকামাত দিতে হয় না।
ঈদের নামাজের পর খুতবাহ প্রদান করতে হয়। খুতবাহ মানে ভাষণ বা বক্তৃতা। ঈদের খুতবাহ প্রদান ও শ্রবণ উভয়ই ওয়াজিব। সকল প্রকার খুতবার সময় মুক্তাদিগণের নীরবতা ওয়াজিব। এ রাতের অন্যতম আমল হলো চাঁদ দেখা। এটি একটি সুন্নত আমল ও ফরজে কিফায়া। চাঁদ দেখলে বা চাঁদ দেখার সংবাদ পেলে এই দোয়া পড়বে-‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমান, ওয়াছ ছালামাতি ওয়াল ইসলাম ; রব্বি ওয়া রব্বুকাল্লাহ। হিলালু রুশদিন ওয়া খায়র। অর্থ : হে আল্লাহ! এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা ঈমান, প্রশান্তি ও ইসলাম সহযোগে আনয়ন করুন ; আমার ও তোমার প্রভু আল্লাহ। এই মাস সুপথ ও কল্যাণের। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৫১) ঈদের রাতটি (চাঁদরাত) মুমিনদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। তাই এই রাতে অনর্থক কোনো কাজে লিপ্ত না হয়ে তার যথাযথ মর্যাদা দেওয়াই একজন প্রকৃত মুমিনের কাজ।
ঈদুল ফিতর বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব। ঈদের মাধ্যমে যে আনন্দ আত্মতৃপ্তি অনুভব হয় তা অন্য কোনো উৎসবে হয় না। অন্যান্য উৎসব থেকে ঈদের পার্থক্য হল–সবাই এর অংশীদার। সবার মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মধ্যে রয়েছে অপার আনন্দ। ঈদের দিন ধনী–গরিব নির্বিশেষে সবাই এককাতারে শামিল হয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি কামনা করে। ঈদ শুধু আনন্দ উৎসবের নাম নয় বরং মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে মুসলিম মিল্লাতের জন্য একটি বিশেষ রহমত ও আল্লাহর দেয়া আদেশ। যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহতায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি। দুনিয়াবাসী এই দিনকে ঈদের দিন বললেও আসমানে একে বলা হয় ইয়াউমুল জায়িজা বা পুরস্কার প্রদানের দিন। এদিন আল্লাহ তার রোজাদার বান্দাদের পুরস্কৃত করে থাকেন। ঈদের দিনেও বিশেষ কিছু ইবাদত বা আমল রয়েছে যেগুলোতে অনেক পুণ্য লাভ করা যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন যে ব্যক্তি পাঁচটি রাত জেগে ইবাদত করবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। তবে, ঈদ মোবারক বা শুভকামনামূলক যে কোনো বাক্য ব্যবহার করে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। ঈদের আনন্দঘন মুহূর্তে সবার মাঝে ভ্রাতৃত্ববন্ধন দৃঢ় হোক। বিলুপ্ত হোক সব ভেদাভেদ। ঈদ হোক সবার জন্য সমান খুশির। ঈদ মোবারক।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।