ই-কমার্স ব্যবসাকে মানুষের আস্থায় নিয়ে আসা উচিত

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

একসময় চিঠি, পত্রিকা, নথিপত্র একস্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানোর জন্য দেশে একমাত্র মাধ্যম ছিলো সরকারি ডাকঘর। যাদের পরিবারের সদস্য বাড়ির বাইরে অন্যকোনো স্থানে থাকতো, তারা একটি চিঠির জন্য প্রতিদিন ডাকঘরে ধরনা দিতো। প্রতিটি ডাকঘর ও ডাক পিয়ন ছিলো মানুষের অতি আপনজন। ডাকঘরকে ঘিরে রচিত হয়েছে অনেক কবিতা, উপন্যাস গান ও প্রবন্ধ। সময়ের সাথে ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বর্তমানে চিঠির গুরুত্ব অনেকখানি কমে গেছে। মানুষ এখন ঘরে বসে প্রযুক্তির কল্যাণে মুহূর্তে পৃথিবীর সব স্থানে যোগাযোগ করতে পারে। তাই ডাকঘরের জৌলুশও আগের মত নেই। তবে ব্যবসায়িক ও অফিসিয়াল ডকুমেন্ট, জরুরি কাগজপত্র ও পার্সেল পাঠানো আগের চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে। ডকুমেন্ট বাড়লেও ডাক বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা আগের মত নেই। এই সুযোগে ডকুমেন্ট ও চিঠিপত্র পাঠানোর মাধ্যম হিসাবে মানুষ বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ঢাকা চট্টগ্রাম ও বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে প্রেরিত লাখ লাখ ডকুমেন্ট বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠানো হয়। প্রশ্ন হলো ডাকবিভাগের কর্মকর্তারা কি কখনো ভেবে দেখেছেন, কেন ঐ ডকুমেন্টগুলো ডাক বিভাগের মাধ্যমে পাঠানো হয় না? কেন মানুষ সরকারি ডাকঘর ছেড়ে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতি আকৃষ্ট হলো? কারণ বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসগুলো ডাক বিভাগের চেয়ে দ্রুত ও নিরাপদ সার্ভিস দিয়ে থাকে। প্রতিটি ডকুমেন্ট নির্দিষ্ট দিনে গন্তব্যে ডেলিভারি করে। ডকুমেন্ট হারানোর প্রবণতা খুব কম। শহরের প্রতিটি এলাকা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ডকুমেন্টস সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে। অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় কর্পোরেট গ্রাহকের অফিস হতে ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে। সর্বোপরি বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস গুলোর কাজের জবাবদিহিতা আছে।এক্ষেত্রে সরকারি ডাকবিভাগ পিছিয়ে আছে। জিপিওগুলো ছাড়া অন্যান্য ডাক অফিসগুলো অফিস সময় ৯-৫ টার পর খোলা পাওয়া যায় না। সরকারি বলে গ্রাহকের প্রতি তাদের জবাবদিহিতা নেই। তবে ডাকবিভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেদের ব্যবসায় নতুন নতুন সেবা চালু করেছে। কিন্তু এরপরেও তারা পেরে উঠছে না। এখনো ডাকসংক্রান্ত যত সেবা ডাকঘরে পাওয়া যায়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তত সেবা দিতে পারে না। কারণ সারা দেশে উপজেলা থানা ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত রয়েছে ডাকবিভাগের অফিস। প্রত্যন্ত বাজার, ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে ডাকবক্স। পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশের সহিত রয়েছে ডাকবিভাগের চুক্তি। এছাড়া ডাক বিভাগের সেবা এখন পর্যন্ত সাশ্রয়ী ও নিরাপদ। বর্তমানে ডকুমেন্ট প্রেরণের ক্ষেত্রে ডাকঘরে পাওয়া যায় দুই ধরনের সেবা। একটা হলো সাধারণ সেবা ও অন্যটি এক্সপ্রেস সেবা। সাধারণ সেবায় সময় একটু বেশী লাগে তবে খরচ কম আর এক্সপ্রেস সেবায় সময় কম লাগে কিন্তু খরচ বেশী। দ্রুত এই সেবা দেশে জিইপি ও বিদেশের ক্ষেত্রে ইএমএস নামে পরিচিত। বিশ্বের ৪৩টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ডাকবিভাগের ইএমএস সার্ভিস চালু রয়েছে। এর বাইরেও ডাক সংক্রান্ত আরোও বেশ কিছু সেবা দেয় ডাকঘর। যেমন পোস্ট ব্যাগ, ভ্যালু পেয়েবল পোস্ট (ভিপিপি), সার্টিফিকেট অফ পোস্ট ও স্পিড পোস্ট। পোস্ট ব্যাগের মাধ্যমে বছরে ৩০০ টাকায় ডাকঘরে বিশেষ ব্যাগ ভাড়া নেওয়া যায়। যেখানে ভাড়া গ্রহণকারীর নামে আসা ডক্যুমেন্ট জমা থাকে। ভিপিপিতে প্রাপক পণ্য পাওয়ার পর ডাকপিয়ন বা কর্মকর্তার কাছে পণ্যের দাম পরিশোধ করে। সার্টিফিকেট অব পোস্টিংয়ে পণ্যের ডাক যাচ্ছে, এই নিশ্চয়তার সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। আর স্পিড পোস্টে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আম লিচুসহ মৌসুমী ফল ও শাকসব্জী পাঠানো হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র, সেভিংস একাউন্ট, টাকা ট্রান্সফার, বন্ড ইত্যাদি সেবা রয়েছে। এই সার্ভিস গুলোর জন্য ডাকবিভাগ এখনো সচল রয়েছে। এতো কিছুর পরেও গত ২০২০-২১ সালে ডাকবিভাগের আয় কমে ৩০০ কোটি টাকা হয়েছে। অথচ এর আগের বছর ২০১৯-২০ সালে ছিলো ৪৫১ কোটি টাকা। ২০১৮ -১৯ সালে ছিল ৪৪৫ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ সালে ছিলো ৪০৫ কোটি টাকা। এর কারণ হিসাবে অনেকে বলতে পারেন, করোনার কারণে ডাকবিভাগের আয় কমেছে। অথচ একই সময়ে কুরিয়ার সার্ভিসের বাজার ও আয় দুটোই অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। কারণ করোনার সময় বিধিনিষেধের কারণে রাস্তায় গাড়ি চলাচল, দোকানপাট, মানুষের চলাচল বন্ধ থাকলেও কুরিয়ার সার্ভিসের সেবা আগের তুলনায় বেশি সচল ছিলো। ঘরবন্দী মানুষের দুয়ারে নিত্যপণ্য, খাবার, ওষুধ ও অন্যান্য পণ্য পৌঁছে দিয়েছে কুরিয়ারের লোকজন যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। করোনার কারণে অনলাইনে কেনাকাটা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে ফলে কুরিয়ার ব্যবসারও প্রসার ঘটেছে ও বেড়েছে। ২০২০ সালে কুরিয়ার এসোসিয়েশনের সদস্য ছিলো ১১১। ২০২১ এর জুনে হয় ১৩৮টি। করেনার আগে অনলাইনে অর্ডার হতো দিনে ৪০ হাজার। এখন হয় আড়াই লাখ। সংশ্লিষ্টদের ধারণা গত দেড় বছরে কুরিয়ার ব্যবসার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫০%। এই সময়ে নতুন নতুন কুরিয়ার কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এখন বাজারে প্রায় ৫০০ এর মতো কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি রয়েছে। বর্তমানে এই খাতে ব্যবসা প্রায় ৭০০০ কোটি টাকা ও প্রায় ২ লাখ লোক প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এই খাত যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ তা করোনা আসার পর মানুষ বুঝতে পেরেছে। এক সময় কুরিয়ার ব্যবসা রাজধানী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরে বিস্তৃত থাকলেও বর্তমানে এই ব্যবসা থানা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও বিস্তৃতি ঘটেছে। করোনা আসার পর থেকে গত দেড় বছরে পণ্য পৌঁছানোর আদেশ বেড়েছে ২ গুণ।
অন্যদিকে গতবছর করোনার কারণে মানুষের মধ্যে আতংকের সৃষ্টি হয়। ভয়ে অনেকে বাজারে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। অনেকে সেই থেকে বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে গেলেও হাট বাজারে যাওয়া এখনো বন্ধ রেখেছে। সেই না যাওয়া মানুষদের জীবন যাত্রা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রেখেছে ই-কমার্স খাত। ২০২০ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭০ শতাংশ। কর্মসংস্থানের নতুন খাত হয়ে উঠছে এটি। সেজন্য অনেকেই কুরিয়ার ও ই-কমার্স ব্যবসায় নামছে। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ই-কমার্স ব্যবসার আড়ালে মানুষের শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এতে করোনা আতংকিত অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেছে। তবে এই ই-কমার্স ব্যবসাটি দেশে নতুন হলেও এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত এবং এর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। তাই সরকারের উচিত ঐসব অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে এই খাতকে নিরাপদ করা। প্রয়োজনে ই-কমার্স খাতের জন্য আলাদা নীতিমালা তৈরী করে একে কঠোর নজরদারির ভিতরে নিয়ে আসা। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ই-কমার্স ব্যবসার পুরোটাই প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় এর টোটাল একাউন্টস তদারক ও নিয়ন্ত্রণ করা সরকারের জন্য সহজ। এতে সরকারের রাজস্ব (ভ্যাট, ট্যাক্স) হানির আশংকা কম। তাই ই-কমার্স ব্যবসাকে নিরাপদ করে মানুষের আস্থায় নিয়ে আসা সরকারে উচিত। এতে একদিকে সরকারের রাজস্ব সুরক্ষিত হবে, অন্যদিকে প্রচুর নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশির থেকে শবনম : এক বিপ্লবী নারীর কীর্তিগাথা
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর বিপ্লবী চেতনার উৎস