ইঞ্জিনিয়ার আলহাজ্ব মোহাম্মদ আবদুল খালেক

চট্টগ্রামের সংবাদপত্রের পথিকৃৎ

অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান | রবিবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৭:০১ পূর্বাহ্ণ


চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত রাউজান উপজেলা শিক্ষাদীক্ষা- সংস্কৃতিতে অগ্রসর এলাকা। উপজেলার কেন্দ্রস্থলে রাউজান পৌরসভার এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের নাম সুলতানপুর। এ গ্রামের মরহুম বেলায়েত আলী চৌধুরী ও বেগম ফজিলাতুন্নেছার ঔরসে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাইয়ের এক শুভক্ষণে একটি শিশুর জন্ম হয়। সেই আনন্দঘন মুহূর্তে ইসলামী শরীয়ত মতে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুটির নাম রাখা হয় মুহাম্মদ আবদুল খালেক। অতি অল্প বয়সেই তিনি পিতৃহারা হন।
ধার্মিক পরিবারের ছেলেটি শিশুকাল হতেই বড়দের সাথে মসজিদে যেতেন। শৈশব থেকেই তাঁর ব্যতিক্রমী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে পাড়াপশীরা ভবিষ্যতে বড় ভাল মানুষ হবে বলে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। ধার্মিক ও সুস্থ মূল্যবোধ সম্পন্ন পরিবারে বেড়ে উঠার কারণে তাঁর মধ্যে উন্নত মানসিকতা ও নৈতিকতাসম্পন্ন চরিত্রের সমাহার ঘটে। নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হয়ে তিনি নিজেকে বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন আলোকিত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন বিধায় সমাজকে আলোকিত করতে অবদান রাখা সম্ভব হয়েছিল। পাঁচ বছর বয়সে রাউজান স্টেশন প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। রাউজান আর আর এসি ইনস্টিটিউশন হতে ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বঙ্গীয় বৃত্তি লাভ করে সকলের প্রশংসা অর্জন করেন।
একই স্কুল থেকে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রাস (এস এস সি) পরীক্ষায় চট্টগ্রাম জিলায় প্রথম হয়ে প্রথম বিভাগে পাস করেন। এরকম প্রতিভাসম্পন্ন কৃতিছাত্রকে দেখার জন্য দশ গ্রামের অনেক মানুষ তাঁকে দেখতে আসতেন, দো’আ করতেন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করে। ১৯১৪ সালে জেলা বৃত্তি নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই এস সি পাস করে কৃতিত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন।
চাচা আহমদ চৌধুরীর বদান্যতায় কলকাতায় পাঁচ বছর শিক্ষা গ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পাস করেন।
১৯২০ সালে চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানীতে সহকারী তড়িৎ প্রশৌশলী পদে চাকুরী শুরু করেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পান। অধিকতর মহত্বের কাজে মানব কল্যাণ ও সমাজ সেবার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ থাকার কারণে তিনি ১৯৩২ সালে চাকুরীতে ইস্তফা দেন। কর্তৃপক্ষ আরো পদোন্নতি ও বর্ধিত বেতনে চাকুরীর প্রস্তাব দেয়াতেও তিনি চাকুরীতে পুনর্বাসিত হতে চাননি। কোনো এক সময় সহপাঠি আবদুল জলিল বি.এ. (আলীগড়) মাস্টারের সাথে স্বল্প সময়ের জন্য রেংগুন গমন করেন। জলিল সাহেব ইস্পাহানি আবাসিক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে রেংগুনে কর্মরত ছিলেন, সেখানে থাকাবস্থায় বন্ধুবর জলিল সাহেবের সৌজন্যে আওলাদে রাসূল কুতুবুল আউলিয়া হযরতুল আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্‌ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বাঙ্গালী মসজিদের খতীব’র সাথে সাক্ষাৎ প্রাপ্ত হন। সে সময়েই ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বন্ধু আবদুল জলিলের উৎসাহে হুজুরের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করে ধন্য হন। কিছুকাল রেংগুনে অতিবাহিত করে স্বদেশে ফিরে আসেন। তারপর শুধুই ইতিহাস, আরো কয়েকবার তিনি রেংগুন ভ্রমণ করেন।
সাদা কালো শশ্রুমন্ডিত সৌম্যকান্তি চেহারায় নূরানী ঝলক উদ্ভাসিত হতো সর্বদা। আকর্ষণীয় নূরানী চেহারার দিকে তাকালে অজান্তে শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে উঠতো যে কারো মন।
ব্যবসায়ী জীবনের শুরুতে ১৯২৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন কোহিনূর লাইব্রেরি। অথচ তড়িৎ প্রকৌশলীর ব্যবসা হওয়া ছিল লব্ধ জ্ঞান বিষয়ভিত্তিক। জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের মহাসোপান হচ্ছে লাইব্রেরি বা পাঠাগার। বিনে পয়সায় গরীব শিক্ষার্থীদের বই প্রদান, পত্রিকা পড়া ও বই পড়ার সুযোগ ছিল কোহিনূর লাইব্রেরীতে। জ্ঞানার্জন ও পাঠক সৃষ্টি করার গভীর প্রত্যয় নিয়ে তিনি প্রথম এ ব্যবসার গোড়াপত্তন করেন। সম্মানজনক পদবী ও মোটা অংকের মাসোহারা ত্যাগ করে সামান্য একটা লাইব্রেরি স্থাপন করায় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই মন ভারাক্রান্ত করেছিলেন সে সময়। কিন্তু স্থির প্রতিজ্ঞা ও লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করলে সুনাম অর্জনে সহায়ক হয়। তেমনি কয়েক বছরের মধ্যে কবি, সাহিত্যিক, জ্ঞানী-গুণী অনেকেই এ লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠক বনে যান। জ্ঞান আহরণে সমৃদ্ধ হন। কিছুদিনের মধ্যে (১৯৩০ সালে) কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস স্থাপন করেন। ছাপাখানা জগতে নবদিগন্তের সূচনা করেন। উভয় প্রতিষ্ঠান ঐতিহাসিক আন্দরকিল্লা মোড়ের দু’পাশে অবস্থিত। অর্থপ্রাপ্তির চেয়ে বইপড়া, জ্ঞানসমৃদ্ধ হবার অভ্যাস গড়ে তোলার প্রয়োজনেই তিনি পাঠাগার ও ছাপাখানা স্থাপন করেন একটি অপরটির পরিপূরক হিসেবে।
‘কোহিনূর’ পারিবারিক কারো নাম নয়। মুসলমানদের শৌর্যবির্যের প্রতীক মুঘল সাম্রাজ্যের মহামূল্যবান হীরক খন্ডের মুকুটকে স্মরণ করেই এ নামকরণ। মুসলমান কবি, সাহিত্যিকদের রচনা ছাপানোর জন্য কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বল্প অর্থে বা বিনা অর্থে ছাপার কাজ করে দিতেন।
দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি আপন মুর্শিদ আউলাদে রসূল কুতবুল আউলিয়া হযরতুল আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্‌ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর দো‘আ প্রার্থনা করেন। হুযুর পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা ও স্থায়িত্বের জন্য দোআ করেন এবং হুজুরের মুরীদানদের সকলকে পত্রিকা ক্রয় করে পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। হুজুর আরো বলেছিলেন এ পত্রিকা দ্বীন, মিল্লাত, মাযহাব ও কওমের খেদমত আঞ্জাম দিবে ইনশাআল্লাহ্‌। অসংখ্য ঘাত-প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়েও বন্ধুরপথ পাড়ি দিয়ে ‘দৈনিক আজাদী’ বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে চলেছে। এ পত্রিকার বৈশিষ্ট্য হলো শরীয়ত, তরিকত তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের প্রচার প্রসারে অনন্য ভূমিকা পালন ও লেখক কবি সাহিত্যিক সৃষ্টি করা যা এখনো অব্যাহত রয়েছে।
ইমামে আহলে সুন্নাত শেরে বাংলা আজিজুল হক আলকাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র ওপর ওহাবীদের সশস্ত্র আক্রমণ ও দৈহিকভাবে লাঞ্চিত করার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং আদালতে মামলা চলাকালে সার্বিকভাবে সহায়তা করার ফলে দোষীদের জেল জরিমানা হয়েছিল।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের খতীব হিসেবে আউলাদে রসূল হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ আবদুল করিম (রাহ.)কে নিয়োগ দেয়া হলে একদল নবী-ওলী দুশমন মুসল্লিদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। তখন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বিজ্ঞপ্তি ছাপিয়ে যৌক্তিক বক্তব্য প্রদান করে মুসল্লীদের শান্ত করেন এবং খতীব সাহেব নির্বিঘ্নে বহু বছর ইমামত ও খেতাবতের দায়িত্ব পালন করেন। ভিক্ষুক আসলে তাকে আজাদী পত্রিকার কতগুলো কপি হাতে দিয়ে এগুলো বিক্রি করে কমিশন নিয়ে জীবিকার্জন করার পরামর্শ দিতেন। এভাবে অনেক পত্রিকা হকার সৃষ্টি করেছেন তিনি।
রেঙ্গুনে গিয়ে তিনি পীর ছাহেব ক্বিবলা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে চট্টগ্রাম আসার অনুরোধ জানান। ১৯৪১ সালে রেঙ্গুন ত্যাগ করে ছিরিকোট শরীফে প্রত্যাবর্তনকালে হুযুর চট্টগ্রামে সংক্ষিপ্ত অবস্থান করেন। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের ওপর তলায় হুজুর ক্বিবলার অবস্থান ছিল বিধায় এটা খানকাহ শরীফ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখান হতে সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়া তথা সুন্নীয়তের আন্দোলনের গতি সঞ্চার হয়। ১৯৪২ সাল হতে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর হুজুর চট্টগ্রাম তথা পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের ওপরের তলায় অবস্থান করে শরীয়ত তরীক্বতের যাবতীয় কার্যাদি সম্পন্ন করতেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ধার্মিক স্ত্রী হুজুরের খানাপিনা, আগত মেহমানদের আপ্যায়ন প্রভৃতি কাজ অত্যন্ত আগ্রহ ও নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করতেন। হুজুর তাকেও খুবই স্নেহ করতেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই ছিলেন ফানফিশ্‌ শায়খ।
ঐতিহাসিক দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কোহিনূর লাইব্রেরির ওপর তলায় তাঁরই উপস্থিতিতে হতো। তিনি আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া পরিচালনা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পদে অধিষ্ঠিত থেকে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন। হুজুর সিরিকোটি (রাহ.) ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ছাহেবের খেদমত ও দ্বীন-মাযহাব মিল্লাতের প্রচার-প্রসারে নিঃস্বার্থ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রিয় মুরীদানকে সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার খেলাফতদানে গৌরবান্বিত করেন। নিরহংকার, সদা হাস্যোজ্জ্বল অভিব্যক্তি, স্নেহ-মমতায় কথোপকথন, প্রচার-বিমুখ কার্যক্রম তাঁকে পীর ভাইসহ সকল পেশা শ্রেণির মানুষের নিকট অত্যন্ত প্রিয়ভাজন করে তুলেছিলেন। কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী সরকারি আমলা থেকে শুরু করে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এমন কি ভিক্ষুক পর্যন্ত সকলের নিকট ইঞ্জিনিয়ার সাহেব পরম শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। মুরুব্বীদের নিকট শুনেছি, আমি নিজেও প্রত্যক্ষ করেছি যে, তিনি যার সাথে কথা বলতেন, সেই তাঁকে আপন মনে করতেন। সকলের সুখ-দুঃখের সাথী হিসেবে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন।
মুর্শিদের সাথে বিচ্ছেদ তাঁকে খুব বেশি ব্যথিত করেছিল। অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর এ মহান ব্যক্তিত্ব সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার উজ্জ্বল নক্ষত্র পীরভাইদের নয়নমণি সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু সমাজ সচেতন আলোকিত মানুষ শ্রদ্ধাস্পদ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজেউন)।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আপন মুর্শিদের দিকনির্দেশনা, হেদায়ত আমল করে কাটিয়েছেন। মরহুমের একমাত্র পুত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের সম্মানিত উপদেষ্টা। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক ও তাঁর বিদূষী স্ত্রী মালেকা বেগমকে জামেয়া মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আনজুমান ও জামেয়া তথা সিলসিলার প্রচার-প্রসারে তাঁর অমূল্য অবদানের কারণে তিনি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল পথিকৃৎ। তাঁর আদর্শ অনুসরণে আমরা হতে পারি আল্লাহ্‌-রসূল (দ.)এর নৈকট্যধন্য ও মুর্শিদে বরহকের যোগ্য মুরীদ। আমাদের এ অভিভাবকের দরজা আল্লাহ্‌ জাল্লাশানুহু বুলন্দ করুন।
লেখক: প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স সেক্রেটারি- আনজুমান-এ রহমানিয়া

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজাদীর মাধ্যমে চট্টগ্রামবাসীর অন্তরে জাগরুক থাকবেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব
পরবর্তী নিবন্ধচলে গেলেন নাট্যনির্মাতা সাখাওয়াৎ মানিক