আসামি সাবেক ডিসি এডিসি পৌর মেয়রসহ ৪০

কক্সবাজারে জমি অধিগ্রহণে অনিয়ম, চার্জশিট চূড়ান্ত

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২৯ জুলাই, ২০২১ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীতে “প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণে অনিয়ম, নেপথ্যে স্ত্রী-শ্যালকসহ পৌর মেয়র, অনুসন্ধানে দুদক, কক্সবাজার ভূ-উপরস্থ পানি শোধনাগার স্থাপন প্রকল্প” শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এক বছরের মাথায় দুদকের মামলায় অভিযুক্ত হতে যাচ্ছেন সাবেক এক জেলা প্রশাসক (ডিসি), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র। তাঁরাসহ কক্সবাজার পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ দুর্নীতির ঘটনায় জড়িত প্রায় ৪০ জনের অধিক ব্যক্তিকে আসামি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগপত্র চুড়ান্ত করেছে বলে জানা গেছে। তদন্তে মামলার এজাহারভূক্ত ৩নং আসামি সার্ভেয়র মো. ফরিদ উদ্দিনকে (৩৬) সাবেক এক ডিসি ও এডিসির সোর্স এবং কালেক্টর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। মূলত, ২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি র‌্যাবের অভিযানে ঘুষের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকাসহ কক্সবাজার এলএ শাখার সার্ভেয়র ওয়াশিম খান গ্রেপ্তারের মামলা তদন্তে নেমে উক্ত জমি অধিগ্রহণে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের সত্যতা পায় দুদক। কক্সবাজার পৌরসভার বাসিন্দাদের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে নেয়া ‘কক্সবাজার শহরে ভূ-উপরস্থ পানি শোধনাগার স্থাপন’ প্রকল্পটি কক্সবাজারে ‘প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প’ হিসেবে খ্যাত।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার এলএ শাখার সার্ভেয়র ওয়াশিম খান গ্রেপ্তারের ঘটনায় গত বছরের ১০ মার্চ চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় ওয়াসিম খানকে প্রধান আসামি করে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এ মামলা করা হয়। পরে তদন্তে নেমে প্রায় ১৩ জনকে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন। তন্মধ্যে চারজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতে দেয়া জবানবন্দি ও তদন্তে নেমে তদন্ত কর্মকর্তা পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ দুর্নীতিতে ৪০-৪৫ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পান। কয়েকজন ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। জড়িত অনেকের ব্যাংকের নগদ অর্থ ও দলিল জব্ধ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এ দুর্নীতির ঘটনায় সাবেক এক জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, পৌর মেয়র ছাড়াও কঙবাজার সদর উপজেলার সাবেক একজন ইউএনও, ৪ জন সাবেক এসি ল্যান্ড (তাদের একজন বর্তমানে বিআরটিএ চট্টগ্রামে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত), দুইজন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, একজন অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা, ৩ জন কানুনগো, ৫ জন ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা, একজন রেকর্ড কিপার, ৯ জন সার্ভেয়র, একজন সরকারি কৌসুলী (জিপি), একজন প্রতারণামূলক জমি ক্রেতা, মেয়রের স্ত্রী, মেয়রের ছেলে, শ্যালক, একজন পৌর কাউন্সিলর, ২ জন জাল দলিল সৃজনকারী চিহ্নিত প্রতারক, ৬ জন ঝামেলাযুক্ত জমির দাতা-গ্রহীতা-সনাক্তকারী, একজন দলিল লেখক, ২ জন দালালের সম্পৃক্ততার প্রমাণ যান। যাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অভিযোগপত্র চুড়ান্ত করা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
সূত্রে জানা গেছে, কঙবাজার পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্পের এল.এ মামলা নং-৪/২০১৯-২০২০ মূলে অধিগ্রহণকৃত জমির প্রত্যাশী সংস্থা হচ্ছে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। মামলার আসামিরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে পাশ কাটিয়ে সদর ভূমি অফিস ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অনিয়মের মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের সত্যতা পান দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। তাছাড়া জমির মূল মালিকের নামে ৮ ধারার নোটিশ জারি হলেও ক্ষতিপূরণের টাকা অন্যজনকে প্রদানের বিষয়েও নিশ্চিত হন তদন্ত কর্মকর্তা। ইতোমধ্যে ৪৭ শতাংশ জমির জন্য প্রায় ৭ কোটি টাকার বেশি প্রদান করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
তাছাড়া গ্রেপ্তার হওয়া দালাল মো. সেলিম উল্যাহ, মো. সালাউদ্দিন ও মো. কামরুদ্দিন জমি অধিগ্রহণের কমিশন থেকে ঘুষ হিসেবে মেয়র, মেয়রের ছেলে, শ্যালক, তিন সার্ভেয়র ও এক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তাকে বিভিন্ন অংকে আড়াই কোটি টাকার বেশি ঘুষ দিয়েছেন বলে আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন। তাছাড়া এজাহারনামীয় আসামী সার্ভেয়র মো. ফরিদ উদ্দিন ডিসি ও এডিসির প্রতিনিধি হয়ে ৬৬ লক্ষ ৭৫ হাজার ৫৫০ টাকা গচ্ছিত রাখার বিষয়টির সত্যতা পান তদন্ত কর্মকর্তা। ঘুষের ওই টাকাই অভিযানের সময় সার্ভেয়র ওয়াসিম ও সার্ভেয়র ফরিদ উদ্দিনের বাসা থেকে র‌্যাব উদ্ধার করে বলে নিশ্চিত হন তিনি। অভিযানে ওয়াসিম গ্রেপ্তার হলেও ঘটনাস্থল থেকে সার্ভেয়র ফরিদ পালিয়ে যান বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
এ নিয়ে দন্ডবিধি’র ১৬১, ১৬২, ২০১, ৪০৯, ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১, ১০৯ ধারা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪ (২) ধারা তৎসহ ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অভিযোগপত্র দেয়ার বিষয়টি চুড়ান্ত করেছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনের মুঠোফোনে ফোন করা হলে তিনি অসুস্থ দাবি করে লাইন কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন করেও তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আজাদীকে জানান, ‘কঙবাজারে ঘুষের টাকাসহ গ্রেপ্তার হওয়া সার্ভেয়র ওয়াসিমসহ তিন জনের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাটি তদন্তে আরও কয়েকটি প্রকল্পের অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে। তন্মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভার পানি শোধনাগার প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। ওই প্রকল্পের বিষয়ে আলাদা অভিযোগপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধকক্সবাজার বান্দরবানে বন্যায় পানিবন্দী লাখো মানুষ
পরবর্তী নিবন্ধবায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পেতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে