আল্লাহর কুরআন মানব মনে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী মহাশক্তি

অধ্যক্ষ হাফেজ কাজী আব্দুল আলীম রিজভী | শুক্রবার , ৫ এপ্রিল, ২০২৪ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন, ‘তূর পর্বতের শপথ, এবং ঐ কিতাবের যা লিখিত রয়েছে, উন্মুক্ত দপ্তরের মধ্যে, এবং বায়তুল মা’মুরের এবং সমুন্নত ছাদের। এবং অগ্নিপ্রজ্বলিত সমুদ্রের। নিশ্চয় আপনার প্রতিপালকের শাস্তি অবশ্যম্ভাবী। সেটা কেউ দূরীভূত করতে পারবে না। যেদিন আসমানে আন্দোলিত হবে আন্দোলিত হবার মতো। এবং পর্বতমালা চলার মতো চলতে থাকবে। সুতরাং সেদিন দুর্ভোগ অস্বীকারকারীদের জন্য। যারা অসার কার্যকলাপের মধ্যে খেলা করছে। সে দিন তাদেরকে জাহান্নামের দিকে সজোরে ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে যাওয়া হবে। এটা হচ্ছে ঐ আগুন যাকে তোমরা অস্বীকার করতে। তবে কি এটা যাদু ? না তোমরা দেখতে পাচ্ছো না? তোমরা তাতে প্রবেশ করো এবং এখন চাই ধৈর্য ধরো কিংবা নাই ধরো উভয়টাই তোমাদের জন্য সমান। তোমাদের জন্য সেটারই প্রতিদান, যা তোমরা (জাগতিক জীবনে) করছিলে।

(সূরা তূর ১১৬ নং আয়াত)

আনুষঙ্গিক আলোচনা : উদ্ধৃত আয়াতত্রয়ের ব্যাখ্যায় তাফসীর শাস্ত্র বিশারদগণ বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। নিম্নে তা লিপিবদ্ধ করা হলো। প্রথমত : ‘তূর’ ইবরানী তথা হিব্রু ভাষায় এর অর্থ হলো পর্বত যাতে হরেক রকম লতাপাতা ও বৃক্ষরাজি উদগত হয়। ‘তূর’ নামক পর্বত খানা কুরআনে করীমের বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন নামে উল্লেখিত হয়েছে। যেমনসূরা ‘আততীন’ এর মধ্যে ‘তূরে সীনীন’ নামে আর অন্য আয়াতের এর মধ্যে ‘তূরে সাইনা’ নামে উল্লেখিত হয়েছে।

এ ‘তূর’ পর্বতের নামে মহান আল্লাহর কুদরতের যবানে আক্বদাছে শপথ করার সবিশেষ তাৎপর্য ও শ্রেষ্ঠত্ব হলোআল্লাহর মহান নবী সাইয়্যেদুনা মূছা কালীমুল্লাহ আলায়হিমুস সালাম এ পাহাড়ের উপর আরোহণ করত : আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে বাক্যালাপ করেছিলেন। আল্লাহর কুদরতের যবানের কথোপকথনের সবিশেষ বরকত আর সাইয়্যেদুনা মুছা কালীমুল্লাহ আলায়হিস সালামের পবিত্রতম চরন ধূলীর মহত্বে শ্রেষ্ঠত্বে এ পর্বতের মর্যাদা মহিমা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তাই সুপ্রসিদ্ধ তাফসীর বেত্তা ইমাম কাজী নাছিরুদ্দীন বায়জাভী (রহ.) তাফসীরে বায়জাভী শরীফে বলেছেন, ক্বসমের দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ক্বসমকৃত বিষয়ের আজমতমহত্তকে বিশ্ববাসীর সামনে প্রকাশ করা আর বর্ণিত বিষয় বস্তু কে তাগিদ ও জোরদার করাই হলো খোদায়ী ক্বসমের মূল মর্ম, আলোচ্য আয়াতে “তূর” বলে মাদইয়ানে অবস্থিত” তূরে সীনীন কে বুঝানো হয়েছে। ইমাম কুরতুবী তাফসীরে কুরতুবী শরীফে হাদীছে নববী শরীফ উদ্ধৃত করে বলেছেন যেপৃথিবীতে বিদ্যমান চারটি জান্নাতের পর্বতের অন্যতম হলোতূরে সীনীন; নামক পর্বত। যার নামে আল্লাহ বিভিন্ন আয়াতে শপথ করেছেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাগণ কে তাগিদ দিয়েছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য আগত খোদায়ী বাণী ও অবর্তীন ঐশী বিধিবিধান মুমিন নরনারীর জন্য পালন করা অবশ্যম্ভাবী ও বাধ্যতামূলক। (তাফসীরে বায়জাভী ও কুরতুবী শরীফ)

কিতাবে মাসতূর’ তথা লিখিত কিতাব যার নামে মহান আল্লাহ কুদরতের যবানে শপথ করেছেন এর ব্যাখ্যায় মুফাচ্ছেরীনে কেরাম বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেমন কেউ কেউ বলেছেন, এ দ্বারা সর্বপ্রথম অবতীর্ণ মহান আসমানী মহাগ্রন্থ ‘তাওরাত শরীফ’কে বুঝানো হয়েছে। যা সাইয়্যেদুনা মূছা কালীমুল্লাহ (.) এর উপর অবতীর্ণ হয়। আবার কেউ কেউ বলেন, এর মাধ্যমে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী মহান গ্রন্থ কুরআনে করীমকে বুঝানো হয়েছে। যা ইমামুল আম্বিয়া সাইয়্যেদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর অবতীর্ণ হয়। কোনও কোনও তাফসীর বেত্তা বলেছেন ‘কিতাবে মাসতূর’ বলে বান্দার সমগ্র জীবনের সার্বক্ষণিক সকল প্রকার কর্মকাণ্ডের লিখিত রেকর্ড পত্র কে বুঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ এর নামে শপথ করত: এর যথার্থতা ও বাস্তবতা কে সবিশেষ গুরুত্ব সহকারে মুমিন নরনারীর সামনে তুলে ধরেছেন।

কুরআনে করীমে এর বর্ণনায় এরশাদ হয়েছে ক্বেয়ামতের দিন প্রত্যেকের আমল নামা নিজ নিজ গলদেশে ঝুলিয়ে অতঃপর বলা হবেবান্দা। তোমার সারা জীবনের সার্বক্ষণিক আমলের রেকর্ডপত্র তুমি নিজে পাঠ করো। অতএব আজ তুমি নিজেই তোমার আমলের হিসেব গ্রহণকারী হিসেবে যথেষ্ট। (সুবহানাল্লাহ)

উপরোক্ত আয়াতত্রয় এর তাফসীরে মুফাচ্ছেরীনে কেরাম বর্ণনা করেছেনআল্লাহ রব্বুল আলামীন বায়তুল মামূও, সমুন্নত ছাদ তথা দৃশ্যমান সমুন্নত আসমান কিংবা আরশেমুয়াল্লা এবং অগ্নিপ্রজ্বলিত সমুদ্রের শপথ করত: মানব কুলের সামনে উক্ত তিন বৃহত সৃষ্ঠ নিদর্শনের শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ব ও বিশালতা উপস্থাপন করে নিজের সর্বময় কর্তৃত্ব, ক্ষমতা স্রষ্টা সুলভ কুদরতের ইঙ্গিত দিয়েছেন।

বায়তুল মামূর মানে সার্বক্ষনিক মহান আল্লাহর ইবাদত জিকির আজকার, তাওয়াফ ও ধ্যানমগ্নতায় আবাদগৃহ, সপ্তম অসমানে আরশে মুয়াল্লার সম্মুখে অবস্থিত নূরানী ফেরেশতা কুলেয় কাবাকে বায়তুল মামূর বলা হয়। এটা পৃথিবী পৃষ্ঠে অবস্থিত খানায়ে কাবা বায়তুল্লাহ শরীফের ঠিক উপরে অবস্থিত। ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীছের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলে করীম রউফুর রহীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে মেরাজ রজনীতে বায়তুল মামুর শরীফে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এটাই তিনি পরিদর্শন করেছিলেন। এতে প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা ইবাদতের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে অতপর তাদের আর পুনরায় এতে প্রবেশ করার পালা আসে না। প্রত্যহ নতুন ফেরেশতাদের ক্রমিক আসে। (তাফসীরে ইবনে কাছীর)

নূরানী ফেরেশতা কুলের কাবা বায়তুল মামুর শরীফে মেরাজ রজনীতে রাসূলে আকরম নূরে মুজ্জাসসাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বায়তুল মামুর হয় প্রাচীরের সাথে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট দেখতে পান। তিনি ছিলেন দুনিয়ার কাবা বায়তুল্লাহ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা এর প্রতিদানে মহান আল্লাহ তাঁকে আসমানের কাবা বায়তুল মামুর এর সাথে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। (তাফসীরে ইবনে কাছীর)

মুফাচ্ছেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন– ‘মাসযুর’ শব্দটি আরবী। ‘সযর’ থেকে নির্গত। এটা একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়। এক অর্থে অগ্নি প্রজ্বলিত করা। কোনও কোনও তাফসীর বিশারদ এর মতে এখানে এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই আয়াতের অর্থ হলো সমুদ্রের শপথ, যাকে অগ্নিতে পরিণত করা হবে। এ অর্থ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কেয়ামতের দিন সকল সমুদ্র অগ্নিতে পরিনত হবে। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে চতুর্দিকের সমুদ্র অগ্নিতে পরিণত হয়ে হাশরের ময়দানে একত্রে মানুষকে ঘিরে ফেলবে।এই তাফসীরই সাইয়্যেদুনা হযরত ছায়ীদুল ইবনু মূসাইয়্যেব হযরত আলী, হযরত ইবনে আব্বাস ইমাম মুজাহিদ ও উবায়দুল্লাহ ইবনে উমাইয়র রদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত হয়েছে। (তাফসীবে ইবনে কাছীর)

সাইয়্যেদুনা মাওলা আলী (রা.) কে জনৈক ইহুদী প্রশ্ন করল : জাহান্নাম কোথায়? তিনি জবাবে বললেনসমুদ্রই জাহান্নাম। পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থে অভিজ্ঞ ইহুদী এই উত্তর সমর্থন করল। (তাফসীরে কুরতুবী শরীফ)

আল্লাহর পবিত্র বাণী ‘নিশ্চয় আপনার পালনকর্তার আযাব অবশ্যম্ভাবী। একে কেউ প্রতিরোধ করতে পারবে না’ আয়াতদ্বয় হল পূর্বোল্লেখিত খোদায়ী ক্বসম সমূহোর জাওয়াব। একবার সাইয়্যেদুনা হযরত ওমর (রা.) সূরা তূর পাঠ করে যখন এই আয়াতে পৌঁছেন তখন একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বিশ দিন পর্যন্ত অসুস্থ থাকেন। তার রোগ নির্ণয় করার ক্ষমতা কারও ছিল না। (তাফসীরে ইবেন কাছীর)

মহান আল্লাহর আলীশান দরবারে ফরিয়াদ তিনি যেন সবাইকে উপরোক্ত দরসে কুরআনের উপর আমল করার সৌভাগ্য নসীব করেন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্‌রাসা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক সত্যব্রতধারী কর্মবীর সত্যরঞ্জন সিংহ
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা