পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম ডাক ‘মা’। সেই সেরা ও সুন্দরতম বিষয়ে আমার অবিশ্বাস্য সুখানুভূতি। একজন তো আমার জন্মদায়িনী, লালন-পালন করেছেন। মনুষ্যত্ব সেট করে দিয়েছেন মননে-মগজে। আরেকজন জন্ম না দিয়েও অপার মাতৃত্বের স্নেহে আমাকে ছবক দিয়েছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই।’ অসামপ্রদায়িক চেতনা সমৃদ্ধতায় আমার জীবন ভাস্বর করে তিনি আমাকে তাঁর একজন মানবিক সন্তান হিসেবে তৈরি করেছেন। আরেকজন প্রায় অর্ধযুগ আগে আমাদের জীবনের সাথে জড়িয়ে মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বাউণ্ডুলে জীবনধারা পাল্টিয়ে শিখিয়েছেন, ‘সংগ্রাম মুখরতায় অতিক্রম্য জীবনে সাফল্য আসবেই। কারো কাছে প্রত্যাশাহীন জীবন মানেই স্বাচ্ছন্দ্যময় গতিধারা!’ আমার ত্রয়ী মা। এতটুকুন জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দের-সুখের-গর্বের-সুন্দরের বিষয় এটি। কারো জীবনে এমন বিরল সৌভাগ্য আছে কীনা আমার জানা নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, রাউজান থানা আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ১১নং পশ্চিম গুজরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান এবং যুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনী প্রধান, রাউজানে সমবায় আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী মুক্তিযোদ্ধা এ.কে ফজলুল হক চেয়ারম্যানের স্ত্রী মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানকারী বীর নারী ও বিশিষ্ট সমাজহিতৈষী বেগম লায়লা হক আমার জন্মদাত্রী। তিনি আমাকে জন্মের পর থেকেই মানুষ করার চেষ্টায় এসএসসি পাশ করিয়েছেন। মাত্র ‘১৯’ নাম্বার ঘাটতির কারণে এসএসসি’তে আমার মেধাতালিকায় স্থান হয় নি। স্টারমার্ক পাওয়া ছাত্র, মেধাবী কীনা জানিনা! ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি চর্চার মুক্তাঙ্গন’ সরকারি সিটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে এইসএসসি’তে ভর্তি হয়ে মিছিলের প্রিয়মুখ ও সুললিত বক্তব্যে অনেক সিনিয়রকে মোহিত করেছি এবং ভালোবাসায় অভিষিক্ত হয়েছি অধ্যক্ষসহ অনেক বিদগ্ধ শিক্ষক-সিনিয়রের। স্নেহধন্য হয়েছি মরহুম জননেতা তারেক সোলেমান সেলিম, জালাল উদ্দিন ইকবালসহ আরো অনেকের। হঠাৎ করে বজ্রপাতের মতো রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন। পুনরায় ভর্তি কবি নজরুল সরকারি কলেজে। নতুন জীবন-সংগ্রাম। জীবন চলার বাঁকে নতুন অভ্যুদয়। ললাটের লিখন, না যায় খন্ডন। সে সময়ে নানা ঘটনা পরম্পরায় মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, পিআইবি চেয়াম্যান আবেদ খান-এর যোগ্য সহধর্মিণী বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক বোদ্ধা প্রফেসর ড. সানজিদা আখতার শেলী। এ দম্পতি’র ভাষায় আমি তাঁদের ‘রেডিমেইড সন্তান।’ আমার কলেজ জীবন, প্রাচ্যের অঙফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও দীর্ঘ চাকরি জীবনে ঢাকায় আমার ঠিকানা এবং বাবা-মা-প্রিয়’র ভালোবাসার বন্ধন উত্তরার ভাড়াবাসাগুলি ও পরবর্তীতে নিজেদের বাসা ‘আশায় বসতি’।
এরপর অর্ধযুগেরও বেশি সময় তাহা’র সাথে জীবন জড়ালে তাঁর জীবনজয়ী জন্মদাত্রী রিজিয়া বেগম আমার জীবনে আরেক প্রেরণাদায়ী ‘মা’ হিসেবে আবির্ভূত হন। রাউজানের ডাবুয়া নিবাসী খলিফার বাড়ির বিশিষ্ট সমাজসেবী ও দুবাই, টিএনটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মরহুম মোঃ সফিকুল আলমের স্ত্রী তিনি। প্রবাস জীবন থেকে ফিরে দীর্ঘ একুশ বছর আমার অসুস্থ শ্বশুরকে হাতের তালুতে রেখেছিলেন এই মা। রাতদিন এতো সংগ্রাম-পরিশ্রমের পরও স্বর্গীয় হাসিতে উজ্জ্বল থাকতো তাঁর মুখায়ব। অসুস্থ স্বামী, শহরে থেকে ৫ সন্তানের পড়াশোনা চালানো এবং অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ সংগ্রামী নারীর প্রতিনিয়ত যুদ্ধের গল্পগুলি আমাকে প্রেরণা যোগায়। আমি বিস্মিত নেত্রে দেখি কি অলৌকিক শক্তিতে এমন করে তিনি সংসার নামক রণক্ষেত্রে বিজয়ীর হাসি হাসেন। এতো প্রাণশক্তি তিনি কোথায় পান? অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবতা হলো, আমার তিন মায়ের জীবনই সংগ্রাম মুখর। তাঁরা জীবনযুদ্ধে লড়ে বিজয়ী হয়েছেন। একেকজনের রণ কৌশল ছিলো হয়তো ভিন্ন ভিন্ন। তিনজনই মানবিকতায় ভাস্বর। মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। তিনজনই উচ্চ বংশীয়। বনেদী ও সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে স্ব-স্ব স্বামীর বাড়ি এসেছেন এবং জয় করেছেন। এমন মায়েদের স্নেহের পরশে যে সন্তান থাকে তার কাছে পৃথিবীর সব নারীই সম্মানের এবং নিরাপদ। জীবন চলার পথে আমরা সব চাচীকেই …আম্মা, ফুফু আম্মা, খালাম্মা বলে ডাকি এবং আমার অনেক বন্ধুর মা’ই আমাকে তাঁদের সন্তানের ন্যায় স্নেহ করেন। আর আমার নিজের ভাগ্নি-ভাস্তি, সব কাজিনের মেয়েরা কিংবা বন্ধু কন্যাদের সাথে আমার কথোপকথন শুরুর সম্বোধন ‘মা’। এছাড়া, আলাদা করে লাকি’র কথা বলতেই হয়। ওঁর সাথে আমার বাপ-কন্যা সম্পর্ক। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আমার মায়েরা ছড়িয়ে আছেন, যাঁরা আমাকে সন্তানের মায়ায় স্নেহের আঁচলে জড়িয়ে রাখেন। আমার খুব কান্না পাচ্ছে। কালবোশেখীর মতো উতাল-পাতাল ঝড় বইছে অস্তিত্ব জুড়ে আর সে আবহে যতটুকু শক্তিতে কুলোয় চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আমি পৃথিবীর সেরা ভাগ্যবানদের একজন…।’ এ ধারণা নিয়ে যেনো আমার মৃত্যু হয়।