তারা তিনজন নিকটাত্মীয়। একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, একজন মহাবিদ্যালয়ের, আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের। এক দুপুরে চতুর্থ এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যায় তিনজনে পরিবার পরিজনসহ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকই কথাটা পাড়েন। কেমন চলছে পড়ালেখা! বার্ষিক পরীক্ষার বেশ আগে করে নির্দেশনা আসে তাঁদের কাছে- কাউকে ফেল করানো যাবে না। ভুল-শুদ্ধ যাই হোক, খাতায় লেখা থাকলেই পাশ করিয়ে দিতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত পিইসি সমাপনী পরীক্ষার আগেও একইরকম নির্দেশনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকটি বেশ কয়েক বছর উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে দেশের বাইরে থাকায় ‘পিইসি’র মর্মার্থ বুঝতে পারে না। প্রাথমিকের শিক্ষক ভাবীটি খুব ভাল করে সব বুঝিয়ে বলেন তাকে। সব বোঝা গেল, কিন্তু ফেল করানো যাবে না- এ-কেমন কথা! কেউ তো ইচ্ছে করলে কাউকে ফেল করাতে পারে না, পাশও করাতে পারে না। কোথা থেকে নির্দেশনা আসে পাশ করানোর জন্য? ভাবীর সহজ উত্তর- ওপর থেকে। ওপর আবার কী! বিদেশ ফেরত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকটির বোকা বোকা প্রশ্নে হাসির রোল পড়ে যায় সেই ছোটখাট অনানুষ্ঠানিক শিক্ষক বৈঠকে।
এবার মুখ খোলেন মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক আপাটি। তিনি কিছুটা স্বল্পভাষী অন্যদের তুলনায়। শিক্ষার্থীদের ফেল না করানোর নির্দেশনা আসে তাঁদের কাছেও। কেবল কলেজের খাতা নয়, বোর্ডের খাতাও দেখতে হয় হাত খুলে। ঠিক যেন নম্বরের দোকান খুলে বসেছেন শিক্ষকরা। খাতায় কিছু আঁচড় কাটা থাকলেই পাশ মিলে যায় পরীক্ষার্থীদের। পরীক্ষার খাতা নিরীক্ষণ করতে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয় বুকের ভেতর। চাকরি বাঁচাতে নির্দেশনা মানতেই হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকটি স্তব্ধ, বাক্যহারা। কত স্বপ্ন বুকে নিয়ে দেশে ফিরেছেন! এখন তিনি বেশ বুঝতে পারছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু শিক্ষার্থী কেন নিজ থেকে একটা বাক্যও শুদ্ধ করে লিখতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে ফেল না করানোর কোন নির্দেশনা আসে না ওপর থেকে, তবে শিক্ষার্থীদের একাধিকবার পরীক্ষায় বসার সুযোগ থাকে। দু’তিন দফা মানোন্নয়ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে পাশ না মিললেও ভয়ের কিছু নেই। কারণ পরের ধাপে থাকে ওদের জন্য বিশেষ আয়োজন- বিশেষ পরীক্ষা। সেখানেও ‘একবার না পারিলে দেখ শতবারের’ ব্যবস্থা আছে। পাশ না করে যাবে কোথায়! বছর জুড়ে বিশেষ পরীক্ষা, বিশেষ বিশেষ স্পেশাল পরীক্ষা চলতেই থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগে। সেই বিশেষ পরীক্ষার অনুমতিপত্র অবশ্য ওপর থেকেই আসে। অনুমতিপত্র আদায় করতে যত জুতোর তলা ক্ষয় করে শিক্ষার্থীরা, তার কিছুমাত্র যদি শ্রেণীকক্ষে নিয়মিত এসে করে, তাহলে হয়তো এত ভোগান্তি পোহাতে হয়না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় নাম ওঠানোর পর তাদের কত কাজ বেড়ে যায়! অনেক বড় বড় দায়িত্ব তাদের পালন করতে হয়! নিজ এলাকায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এলে ব্যস্ততার শেষ থাকে না। তাছাড়া দরপত্র, প্রকল্পসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ রাজকার্যে তাদের সময় দিতে হয়! শ্রেণিকক্ষে হাজিরা দিয়ে শিক্ষকদের ভাষণ শোনার সময়, রুচি কিছুই থাকে না ওদের।
পারিবারিক সেই আসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকটির মুখে কথা সরে না। বলাবাহুল্য, তিনজনের মাঝে প্রাথমিকের শিক্ষক সবচাইতে মুখরা। তাঁর অভিজ্ঞতাও বেশীদিনের। অল্প কিছুদিনের মধ্যে অবসরে যাবেন। তিনি ঝটপট বলে ফেলেন- আমরা পার করে দিচ্ছি বলেইনা তোমরা ছাত্র পাচ্ছো। সত্যিই তো, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশীরভাগ বিভাগে শতাধিক ছেলেমেয়ে ভর্তি হয় প্রতি শিক্ষাবর্ষে। তাও আবার ভয়াবহ প্রতিযোগিতামূলক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে। সকলে পরিতৃপ্তি নিয়ে দেখছে শিক্ষার হার সত্তর ছাড়িয়ে আশি শতাংশের দিকে এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে।
তিন শিক্ষকের আলোচনা খাবারের টেবিলে গড়িয়ে বিকেলের চা পর্যন্ত চলে। দেখতে-দেখতে বিদায়ের সময় চলে আসে। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতদিনের দুর্ভাবনা আরও জাঁকিয়ে বসে তাদের মনের ভেতর। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিতরণ নয়, বরং পার করিয়ে দেওয়া কিংবা সনদ পাইয়ে দেওয়াই কী শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব!
আটপৌরে গল্প ছেড়ে এবার একটি ভিন্ন গল্প হোক; ওপরতলার গল্প।
২
তাঁরা দু’জন নামজাদা নাগরিক। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। অন্যজন আদর্শবান খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ। তাঁদের দক্ষতা কর্মনিষ্ঠা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন নেই জনপ্রিয়তা নিয়েও। একবার কোন এক বিশেষ মুহূর্তে জননেতার একজন কাছের মানুষকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানিয়ে দেওয়ার অনুরোধ আসে সেই আদর্শবান শিক্ষকের কাছে। আদর্শবান শিক্ষক আবেদনপত্র দেখে মনস্থির করতে পারছিলেননা। যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে নেতার পছন্দের মানুষকে নিতে তাঁর বিবেকে বড় বাঁধছিল। কিন্তু নেতার কথা ফেলেন কী করে!
অতঃপর কেবল কম যোগ্যতাসম্পন্নই নয়, রীতিমত অযোগ্য সে-প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। সেই আদর্শ শিক্ষক নবাগত প্রভাষককে ডেকে কিছু উপদেশ পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাতে অযোগ্যতা কাটিয়ে উঠে নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন তিনি। কে শোনে কার কথা! যে যার পথেই চলেন। অনেকদিন পর আদর্শ শিক্ষক তাঁর হাতে নিয়োগ পাওয়া সেই শিক্ষকের কর্মকাণ্ড দেখে মর্মাহত হন। নিজের ভুলের জন্য কিঞ্চিৎ অনুতপ্ত হন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। সেই শিক্ষক অধ্যাপক পদে পদন্নোতি লাভ করেছেন, আরও নানান গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিষিক্ত হয়েছেন। এখন তিনি রীতিমত তারকা শিক্ষক। কে জানে, আদর্শ শিক্ষকই হয়ে গেলেন কী না!
নিয়োগদাতা আদর্শ শিক্ষক কিঞ্চিৎ অনুতপ্ত হলেও খুব বেশী বিচলিত নন। কেবলমাত্র এই একজন অযোগ্য প্রার্থীকেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানাননি তিনি। অনুরোধে কত ঢেঁকি যে গিলতে হয়েছিল! শেষ জীবনে এসে এসব নিয়ে ভাবলেও বড় একটা অনুশোচনা হয় না। কারণ অনুরোধের ঢেঁকি গেলার ফল তিনিও যে ভোগ করেছিলেন জনমভর, হাতে হাতে। অনেকেই অযোগ্যতা কাটিয়ে উঠেছে, ভাল কাজের স্বাক্ষর রেখেছে, এটা ভেবে বেশ পুলক জাগে মনে, বার্ধক্যে এসে। মৃত্যুর আগে অনুশোচনা ঘিরে ধরলেও ধরতে পারে। আজকের গল্পের বিষয়বস্তু তা নয়।
এই গল্পেরও কোন উপসংহার নেই। সেই জনদরদী জননেতা ইতোমধ্যে স্বর্গলোকে গমন করেছেন। তাঁর প্রয়াণদিবসে তাঁকে নিয়ে রচিত প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও কবিতায় ভক্তরা নিজেদের উজাড় করে শব্দ সাজান, বন্দনা করেন তাঁর। করবেনই তো। তিনি সত্যিই মহান ছিলেন। জনমানুষের কল্যাণের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন বাংলা মায়ের এই সূর্যসন্তান। একজন কাছের মানুষকে অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানাবার জন্য প্রভাব খাটিয়ে এমন কী মহাপাপ তিনি করেছিলেন! না হয় আরও কয়েকজনের জন্যও একইভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনিতো ওদের ভালই চেয়েছিলেন। তাইতো উপকার করলেন। একবার ভাবুন তো, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন চাকরি পেয়ে ওদের পরিবারের মান মর্যাদা, শানশওকত কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে!
মাত্র তিনশ উনচল্লিশ শব্দের এই ছোট্ট গল্পটি নিয়ে কে বা কারা ভাববে, আদতেই কেউ এর প্রতিকার চাইবে কী না, চাইলেও কোনকিছু বদলাবে কী না- এসব বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাতির সামনে। আকাশপথে একজন বৈমানিকের যে ভূমিকা, জলপথে একজন নাবিকের যে ভূমিকা, সমাজে একজন শিক্ষকের ভূমিকা ঠিক তেমনই (সড়কে গাড়ি চালকের ভূমিকাও তাই)। অযোগ্য, অদক্ষ কিংবা প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়নি এমন কাউকে বৈমানিক বা নাবিক বানিয়ে দিলে বিমান ও জাহাজের ভাগ্যে যেমন ভরাডুবি নিশ্চিত, শিক্ষাঙ্গনে অযোগ্য শিক্ষকের অবস্থানও তেমনি সমাজের ভরাডুবি নিশ্চিত করে। জেনেশুনে আমরা সেই নিশ্চিত ভরাডুবির দিকে কেন এগিয়ে যাচ্ছি, সে প্রশ্নের জবাব কার কাছে চাইব? এই ডুবন্ত সমাজে কেমন করে ভেসে থাকবে আমাদের সন্তানেরা! ওরা বাতিঘর মানবেই বা কাকে!
পুনশ্চঃ করোনার প্রকোপে মুখ থুবড়ে পড়েছে চলমান শিক্ষা ব্যবস্থার। শিক্ষার্থীদের মেধা ও অবস্থান মূল্যায়নে গতানুগতিক পরীক্ষাপদ্ধতি প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। শিক্ষা বা জ্ঞানের আদান প্রদান নয়, বরং সনদ আদান-প্রদানই আমাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্য, একথাই প্রমাণিত হল আবারও। সপ্তাহান্তে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদ্যালয়ে গিয়ে সন্তানের ‘এসাইনমেণ্ট’ জমা দিয়ে বড় দায়িত্ব পালন করছেন বাবা-মায়েরা। এই সুযোগে অনেকদিন পর মায়েদের বাড়ির বাইরে যাবার উপলক্ষও তৈরি হল। তবে ‘এসাইনমেণ্ট’ রচনার কৃতিত্ব কত শতাংশ শিক্ষার্থীর তা একটা বড় প্রশ্ন। আমাদের বাংলাদেশে যেখানে পরীক্ষায় উচ্চ নম্বর প্রাপ্তিই শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে যেখানে বাবামায়েদের অনেকে অর্থের বিনিময়ে অবলীলায় সন্তানকে প্রশ্ন এনে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, সেখানে বার্ষিক পরীক্ষার বিকল্প হিসেবে ‘এসাইনমেণ্ট’ পদ্ধতি কতটা বিশ্বস্ত সে প্রশ্ন তোলা মোটেও অবান্তর নয়। গৃহ শিক্ষক কিংবা বড় ভাই বোনকে দিয়ে ‘এসাইনমেণ্ট’ তৈরি করিয়ে নেওয়ার খবর কানে আসছে প্রতিদিন। সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। বাজারেও নাকি পাওয়া যাচ্ছে ‘এসাইনমেণ্ট’। আমাদের প্রতিভার তুলনা নেই! দুর্নীতির নানান পন্থা উদ্ভাবনে সত্যিই জুড়ি নেই আমাদের। কঠিন দুঃসময়েও অবিচল আমাদের অপকর্মের স্পৃহা।
এত ঢাকঢোল বাজিয়ে শিক্ষা নিয়ে গর্ব করা আমাদের সাজে কী?