আমার শৈশবকালে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের লেখাপড়ার সূত্রপাত হয় আমাদের এলাকার ছিটিয়া পাড়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুল, দক্ষিণ সুলতানপুর, রাউজান, চট্টগ্রামে। শৈশবে প্রথমে একটি বর্ণ বোর্ড বা বাংলা বর্ণমালা বই তারপর ক্রমান্বয়ে বাল্যশিক্ষা, ধারাপাত, সিলেট পেন্সিল এই ছিল প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা উপকরণ এবং এগুলো পাঠের মাধ্যমে আমার শৈশব শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি আরম্ভ হয়। তারপর ধাপে ধাপে প্রথম শ্রেণি হতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধ্যয়ন কাল। আমার অধ্যয়নকালে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষামূলক পরিবেশ এবং লেখাপড়ার মান ছিল অত্যন্ত উন্নত। সে সময়ে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয় একজন আদর্শ জ্ঞানবান, নিষ্ঠাবান, জ্ঞানতাপসের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো। তাঁরই অভিভাবকত্বে দীক্ষিত হয়ে আমার শিক্ষা জীবনের লেখাপড়ার পরবর্তী উন্নত মানসম্পন্ন সোপান নির্মিত হয়েছিল।
বিদ্যালয়ের তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় সর্ব গুণান্বিত জনাব মান্নান মাস্টার নামে সবার নিকট এক নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনিই ছিলেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা হেডমাস্টার এবং দক্ষ পরিচালক। তিনি আমাদের পাঠ্যক্রম সবার নিকট সুখপাঠ্য করার মানসে নিরবচ্ছিন্ন, নিরলস, নিরবধি, নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতেন । তিনি ছাত্রদেরকে খুব স্নেহ মমতা করতেন এবং ভালোবাসতেন কিন্তু নিয়মিত পাঠ্যক্রম আদায় করে নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন কঠোর। বিদ্যালয়টির দক্ষ ও সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষাক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ও অবদান ছিল প্রশংসনীয় এবং স্মরণীয়।
তিনি বিদ্যালয়টিকে আদর্শ ও উন্নতমানের বিদ্যালয়ে পরিণত ও রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছিলেন। তিনি ছাত্রদের উন্নত নৈতিক চরিত্র গঠনে খুবই সজাগ থাকতেন এবং স্কুলের সব ছাত্র যাতে নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে মনোযোগ সহকারে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা গ্রহণ করে সে ব্যাপারে আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতেন। মুসলিম ছাত্রগণ যাতে সময়মতো মসজিদে উপস্থিত হয়ে নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করে সে ব্যাপারে নির্দেশনা ও তাগিদ দিতেন। অর্থাৎ ছাত্ররা যাতে লেখা পড়া শিখার সাথে সাথে সুশৃংখল ও উন্নত নৈতিক চরিত্রবান হয়ে ওঠে সে ব্যাপারে যত্নবান ছিলেন। বিদ্যালয়ের চারদিকের পাড়া-মহল্লার শিশুদের অভিভাবকবৃন্দকে নিজের সন্তানদের লেখাপড়ায় উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করার জন্য ও বিদ্যালয়মুখী করার লক্ষ্যে তিনি প্রায়ই বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকবৃন্দ ও আদর্শ ও মেধাবী ছাত্রদের সমভিব্যাহারে বিদ্যালয়ের চারপাশের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ পাড়া-মহল্লার প্রতিটি ঘরে ঘরে গমন করতেন। তিনি অত্যন্ত বিদ্যানুরাগী, বিদ্যেুাৎসাহী ও শিক্ষার প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন বিধায় ছাত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে এরূপ নিঃস্বার্থভাবে প্রতিটি ঘরে ঘুরে ঘুরে ছাত্র সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছিল।
দীর্ঘদিন ছুটি থাকার দিন মাসগুলোতে তিনি তাঁর বিদ্যালয়ের আদর্শ ছাত্রদেরকে নিজ বসত বাড়িতে নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে ও সযত্নে লেখাপড়া শেখাতেন। আবার তিনি একজন সংস্কৃতিমনা শিক্ষক ছিলেন। প্রতি বৎসর স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা সমাপ্তির পর বিদ্যালয়ের সামনের খোলা মাঠে বিভিন্ন শিক্ষামূলক নাটক মঞ্চস্থ করার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন, যা ছাত্রদের পাঠ্যক্রম বহির্ভূত মেধা, প্রতিভা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করত। শিশুদের জন্য বিভিন্ন খেলাধুলার আয়োজন করতেন, বিদ্যালয়ের ছাত্ররা নাটকে অভিনয় করে এবং গান, গজল ও হামদ ইত্যাদি পরিবেশন করে দর্শকের চিত্ত আকর্ষণ করত এবং আনন্দিত ও মুগ্ধ করত। এ প্রসঙ্গে আমাদের পাড়ার ফরিদের কথা বিশেষভাবে মনে পড়তেছে। সে জোরালো সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে নাত, গজল, হামদ ইত্যাদি পরিবেশন করে দর্শক-শ্রোতাদের আনন্দ দিতো, মুগ্ধ করত। সে ছিল খুবই মেধাবী ও প্রতিভাবান।
কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় দারিদ্রতার নির্মম কশাঘাতে সে প্রাথমিক স্তরেই শিক্ষাঙ্গন হতে ঝরে পড়েছিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের আরেক আদর্শ শিক্ষক ছিলেন মৌলভী সুলতান। তিনি খুবই ধার্মিক ও জ্ঞানী ছিলেন। তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও গুণাবলী স্মর্তব্য। আমাদের আদর্শ প্রধান শিক্ষক মরহুম জনাব সৈয়দ আব্দুল মান্নানের ছাত্রদের লেখাপড়ার প্রতি নিঃস্বার্থ অবদান আমার মনের মণিকোঠায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এ জীবন সায়াহ্নে এসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আমার শৈশবকালীন সহপাঠীদের কথা বারবার স্মরণ হচ্ছে। সমাজে একটি মূল্যবান প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘আদর্শ প্রজ্ঞাবান শিক্ষকরা হলেন শিক্ষিত, সভ্য মানুষ গড়ার কারিগর।’ আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মরহুম জনাব সৈয়দ আব্দুল মান্নান এর ক্ষেত্রে প্রবাদটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য।
তাঁর শিক্ষক জীবনের এই মূল্যবান প্রবাদটি অনুকরণে এবং অনুসরণে সত্যিকার ভাবে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের জন্য তখনকার শিক্ষার অন্ধকার জগতে ধ্রুব তারার মত উজ্জ্বল নক্ষত্র ও দিশারী। আমাদেরকে আদর্শ ছাত্র হিসেবে শিক্ষাজীবনের শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের সঠিক সোপান নির্মাণ ও আরোহণে তার অবদান ছিটিয়া পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একটা কথা এখানে উল্লেখ না করলে আমার মনে চির জীবন দাগ কেটে থাকবে, তা হল তার মৃত্যুর আনুমানিক মাস তিনেক পূর্বে মুন্সিরঘাটা এলাকায় স্যারের সাথে দেখা হয় এবং আমি সশ্রদ্ধভাবে উনাকে সালাম করি। উনি তখন আমাকে বললেন জামাল তোমার মতো আদর্শ ছাত্র আমি শিক্ষক জীবনে আর পাইনি’। উনার এই মূল্যবান উক্তিটি এখনো জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাকে উৎসাহ যোগাচ্ছে। আমি আন্তরিকভাবে তার পরকালীন জীবনের মাগফেরাত কামনা করছি।
আমার প্রাথমিক বিদ্যালয় কালীন শৈশব স্মৃতি হতে স্যারের নাম সৈয়দ আব্দুল মান্নান উল্লেখ করেছি বিধায় প্রকৃত নামের সাথে যদি কোন অমিল থাকে, বিভ্রান্তি থাকে তবে তার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।
লেখক: প্রাবন্ধিক