আমাদের নগরের এক সুবাসিত কবি

কামরুল হাসান বাদল | রবিবার , ১১ জুলাই, ২০২১ at ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ


কবিগুরুর ‘মায়ার খেলা’র চতুর্থ দৃশ্যে অমর কুমার বলছেন,
‘মিছে ঘুরি এ জগতে কিসের পাকে,
মনের বাসনা যত মনেই থাকে।
বুঝিয়াছি এই নিখিলে, চাহিলে কিছু না মিলে,
এরা, চাহিলে আপন মন গোপন রাখে।
এত লোক আছে, কেহ কাছে না ডাকে।’

এমন একটি গভীর বেদনাবোধ নিয়েই কি জীবনের শেষ প্রান্তে নিজের জন্মভিটায় ফিরে গিয়েছিলেন কবি অরুণ দাশগুপ্ত, আমাদের অনেকের দাদামনি? জানি না, সে খবর আমরা রাখিনি। ‘আজ যিনি অপরিহার্য কাল তিনি পরিত্যাজ্য’ এমন একটি সমাজের মানুষ আমরা সে খবর নেবার প্রয়োজনবোধ করিনি।

গন্ধময় এই শহরের সুবাসিত মানুষ কবি অরুণ দাশগুপ্ত কবে, কীভাবে, কেন শহর ছেড়ে নিজ জন্মভিটায় ফিরে গিয়েছিলেন তা কেহই খেয়াল করিনি। এই নাগরিক জীবনের কর্মব্যস্ততা তাঁকে অপাংক্তেয় ঘোষণা করলেও তাঁর আঁতুড়ঘর তাকে ত্যাজ্য করেনি। ধলঘাটের মাটি, জলবায়ু তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেছে, ঠাঁই দিয়েছে আর জীবনের শেষ নিশ্বাস ফেলার অবকাশ করে দিয়েছে।

নিজের জন্মস্থানে ফিরে অত্যন্ত স্বস্তিতে ভানুসিংহের পদাবলী উচ্চারণ করলেন যেন,
‘ মরণ রে,
তুঁহু মম শ্যামসমান।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজূট,
রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট,
তাপ-বিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান।
তুঁহু মম শ্যামসমান।’

মনে পড়ে জ্ঞানী সক্রেটিসের অন্তিম বাক্য, ‘আই টু ডাই, ইউ টু লিভ, হুইচ ইজ বেটার অনলি গড নো’জ।’ এর উত্তর এখনো জানা নেই। তবে আমি মনে করি জীবন সতত সুন্দর। বেঁচে থাকাটা মানুষের মহত্তম সুন্দর। তারপরও যেতে হয়। এটিই পরম সত্য। সে সত্যকে নির্দ্বিধায় বরণ করতে পারে না সবাই। যারা মহৎ প্রাণ তারাই পারেন। তেমনি করে
সে পরম সত্য ও অমৃতের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন আমাদের প্রিয় দাদামনি। তবে তিনি মরে গিয়ে আমাদের জানিয়ে গেলেন আবার, তিনি বেঁচেছিলেন। আমরাই শুধু রাখিনি খবর। আমরা যারা বেঁচে আছি বাঁচার আনন্দ নিয়ে থাকি। পেছনে কে ছিলেন তার রাখি না খবর।
আমরা যারা একসময় তাঁকে ঘিরে থাকতাম তাঁদের এখন চকিত প্রশ্ন, দাদামনি ধলঘাটে চলে গিয়েছিলেন? জানতাম না তো! অথচ তাঁর হাত ধরেই অনেকে লেখালিখির জগতে পরিচিত হয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি আলোকিত করে রেখেছিলেন এই শহরের শিল্পসাহিত্যকে। অভিভাবকের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন।
কল্যাণীতে তাকে কেন্দ্র করে সরস আড্ডা হতো। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং কখনো রাজনীতিও উঠে আসতো আড্ডার বিষয় হিসেবে। শুধু চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশের শিল্প-সমঝদারদের অনেকেই সে আড্ডায় জড়ো হয়েছেন। নিজেরা ঋদ্ধ হয়েছেন, অনুজদের প্রাণিত করেছেন।
কোনো কারণে জীবনের প্রতি একধরনের উদাসীনতা ছিল তাঁর। আমরা যে অর্থে বৈষয়িক বলি তেমন ছিলেন না দাদামনি। সম্পদশালী পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন বলেই বোধহয় পার্থিব সম্পদের প্রতি কোনোপ্রকার লোভ ছিল না তাঁর। অথবা হতে পারে সংসার পাতেননি বলে সংসারী হবার চেষ্টা করেননি কখনো। তিনি, তাঁর পড়াশোনা, আর আজাদী এর বাইরে বোধহয় তিনি কখনো ভাবেননি। ফলে যতদিন শারীরিক সামর্থ্য ছিল ততদিন আজাদীকে আঁকড়ে পড়েছিলেন তিনি।
তাঁর জ্ঞানের পরিধি ছিল ব্যাপক। যেকোনো বিষয়ে কথা উঠলে তিনি অনর্গল বলে যেতে পারতেন। তাঁর সে বলা ভাসা ভাসা নয়, গভীর জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য থেকেই তিনি বলতেন। খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি এতটাই নির্মোহ ছিলেন যে, নিজের লেখা নিয়ে বই করতেও ভীষণ অরাজি ছিলেন । তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা ঠেলেঠুলে না করলে তাঁর কোনো বইও প্রকাশ হতো না। স্বাধীনতার পরপর তৎকালীন সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের হাত ধরে আজাদীতে যোগ দিলেন আর অন্য কোথাও গেলেন না। আশ্চর্য এক মায়ায় জড়িয়ে প্রায় অর্ধ শতক কাটিয়ে দিলেন এখানে।
অত্যন্ত ধোপদুরস্ত জীবনযাপন করতেন তিনি। একটি সামন্ত পরিবারে জন্ম তাঁর। ফলে বেশিদিন গ্রামে থাকতে পারেননি। ধলঘাট স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতায়। তিনি সেখানে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা শেষ করেন। নাড়ির টানে ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পথে। ফলে হাতছাড়া হয়ে যায় বিপুল সম্পদ।
এসময় তিনি মিরসরাইয়ের এক গ্রামে প্রতিষ্ঠিত উচ্চ বিদ্যালয়ে নিলেন শিক্ষকতার চাকরি। এরপর ফটিকছড়ির নারায়ণহাট স্কুলে। অবশেষে সব ছেড়ে দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের হাত ধরে ১৯৭৩ সালে যোগ দেন দৈনিক আজাদীতে।
১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি ধলঘাট গ্রামে জমিদার যশোদা নন্দন ওয়াদ্দেদার (দাশগুপ্ত) এর পুত্র অবিনাশ ওয়াদ্দেদারের ঔরসে জন্ম অরুণ দাশগুপ্ত’র। কবিতা, চিত্রকলা, ছোটগল্প, সঙ্গীত ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। অরুণ দাশগুপ্ত রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থাবলী ‘রবীন্দ্রনাথের ছয় ঋতুর গান ও অন্যান্য’, ‘নবীনচন্দ্র সেন’, ‘কবিতা চিন্তা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, কবিতার বই ‘খাণ্ডবদাহন’। এরপরও জীবন থেমে থাকবে না। আজাদীর সাহিত্য পাতা বের হবে, কোথাও সাহিত্য আসর হবে, কোনো ঘরে আড্ডা হবে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের রিহার্সেল হবে সবই হবে শুধু থাকবেন না চিরকুমার, আধুনিক, সুবাসিত এক কবি অরুণ দাশগুপ্ত সবাই যাঁকে দাদামনি বলে ডাকত। তবে তাঁর সুবাসটুকু থেকে যাবে অনেকের কবিতায়।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচেতনার দীপশিখা
পরবর্তী নিবন্ধঅরুণ দাশগুপ্ত ‘মোর লাগি করিও না শোক’