আমরা শিশু আমরা সুন্দর

জুয়েল আশরাফ | বুধবার , ২৫ মে, ২০২২ at ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

রেললাইনের পাশে নির্মিত বস্তিতে দারিদ্র্যের রাজত্ব, অপরিচ্ছন্ন পোশাক-পরা শিশুরা খেলাধুলা করে। এসব বস্তির বাসিন্দারা আবর্জনা তুলে বা শ্রমিকের কাজ করে। কাসেম বস্তিতে থাকে, মা একটি কারখানায় কাজ করেন, বাবা নেই। ঘরের আর্থিক ঘাটতি। কাসেম পড়াশোনা করতে চায়, কিন্তু বারবার তার সামনে একই ভাবনা আসে… মায়ের কষ্টের কথা। সেজন্য সে জুতা পালিশ করার কাজ করে। স্কুলের সামনে বসে স্কুলের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে।

শায়লা ম্যাডাম এই স্কুলের শিক্ষিকা। কাসেমকে রোজ স্কুলের বাইরে দেখেন আর মনে মনে ভাবেন, এত ছোট একটি ছেলে কাজ করছে! ছেলেটির কেমন বাবা-মা! এতটুকু ছেলেকে পড়াশোনা না শিখিয়ে রোজগার শেখাচ্ছে? বাসায় আসার পরও শায়লা ম্যাডাম ভাবতে থাকেন। ছেলেটির সুশিক্ষা, পরিচ্ছন্ন পুষ্টি নেই…পরে বড় হলে এই ছেলেটি দেশের জন্য কী করতে পারবে? তিনি শিক্ষিকা হয়েও এতকাল দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য কিছুই করেননি। এখন অবশ্যই কিছু করবেন, তিনি শুরু করে দিলেই দেশের সেবা হবে। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন… তিনি অবশ্যই কিছু করবেন।

পরেরদিন শায়লা ম্যাডাম স্কুলের সামনে জুতা পালিশ করা ছেলেটির সামনে এসে দাঁড়ালেন।
তোমার নাম কী ছেলে? আর তুমি এই কাজ কেন করো? তোমাকে কেউ বাধা দেয় না? তোমার লেখাপড়া করার ইচ্ছে নেই?
ছেলেটি কোনো জবাব দিল না। ফ্যাঁলফ্যাল চোখ করে তাকাল শায়লা ম্যাডামের মুখের দিকে।

ভয় পেও না, বলো। এখন তুমি আমাকে বড় বোন ভাবতে পারো!
কিছুক্ষণ ছেলেটি চুপ করে থাকলো। তারপর বলল, আমার নাম কাসেম, আমার মা কারখানায় কাজ করেন, বাবা নেই। তাই মায়ের মতো আমিও কাজ করি।
তুমি কি কখনো স্কুলে যাওনি?
না আপা।
তুমি কোথায় থাকো?
কাসেম কাঁচা আবাসের দিকে ইশারা করে বলল, ওই বস্তিতে থাকি।
পড়ার সুযোগ পেলে তুমি পড়বে?
আমি পড়াশোনা করতে চাই।
আমি অবশ্যই তোমার পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দেব।

এবার কাসেমের মুখে খুশির ছাপ। সে বিশ্বাস করতে পারছে না সে পড়তে পারবে। তাই সে অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, এটা কিভাবে হতে পারে আপা?
শায়লা ম্যাডাম বললেন, কেন তা হতে পারে না, মানুষ তার ভাগ্য নিজেই তৈরি করে! তোমার ভাগ্যও তোমার মুঠোয়।
সত্যি আপা! আপনি আমার বন্ধু শামিম, হাসান, জুহরা, নাজমা আর বেলালকেও শেখাবেন?
হ্যাঁ, কেন শেখাব না? আগামীকাল এই সময়ে মাঠে যাকে খুশি তাকে পড়াশোনা শিখতে তোমার সব বন্ধুদের নিয়ে এসো।
ঠিক আছে আপা।

শায়লা ম্যাডাম বাসায় এলেন। পড়াতে তারও উপকরণ লাগবে ভাবলেন। ছেলেমেয়েগুলো অনেকদিন গোসল করে না। পরেরদিন শায়লা ম্যাডাম ছেলেমেয়েদের মাঠে নিয়ে গেলেন। সবার সাথে পরিচিত হলেন। তারা সত্যিই পড়তে চায়। তাদের স্বপ্ন আছে, মুঠো ভরা স্বপ্ন… সবাই কিছু হতে চায়। প্রথমদিন শুধু কথা হলো। শায়লা ম্যাডাম ছেলেমেয়েদের পরিষ্কার থাকার গুরুত্ব বুঝিয়ে বললেন, আগামীকাল সবাই গোসল করবে। পরিষ্কার জামাকাপড় পরে আসবে।
পরের দিন ছেলেমেয়েদের চেহারা পাল্টে গেল। অনেক সুন্দর লাগছে দেখতে। মাঠের এক পাশে একটা স্কুল চলতে লাগল। ছেলেমেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি শিখছে। এদের নিখোঁজ হওয়ার খবরে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে, তারা ছেলেমেয়েদের খুঁজতে মাঠে আসেন। কিছু মা বললেন, ম্যাডাম! পড়াশোনা নিয়ে লাভ কী? কাজ শিখবে, তাহলেই চার পয়সা আয় হবে।

শায়লা ম্যাডাম তাদের সব রকম ভাবে বুঝিয়ে দিলেন। অবশেষে তারা বুঝতে পারলেন বাচ্চাদের পড়ালেখার গুরুত্ব। ক্রমশ শিশুর সংখ্যা বাড়তে লাগল, এখন এই খবর সংবাদ মাধ্যমে দ্রুত সারা দেশে পৌঁছেছে। সামাজিক সংগঠনগুলো সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে লাগল। শায়লা ম্যাডাম খুব খুশি হলেন। সকলের সাহায্যে তিনি ছেলেমেয়েদের পড়াবার জায়গা পেলেন। এখন সেখানে একটা ছোট স্কুল চালু হলো। জাতীয় শিশু দিবসের পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠান হলো, বর্ণাঢ্য পরিবেশনা, দেশপ্রেমে ভরা পরিবেশে। শেষ অনুষ্ঠানটি ছোট শিশুদের। শিশুরা গান আরম্ভ করছে, সব শিশু একসাথে বললো- আমরা শিশু আমরা সুন্দর… ভিক্ষায় মুক্তি পাব না… ভিক্ষায় মুক্তি পেলেও আমরা নেব না… ভাগ্য আমাদের মুঠোয়…। শায়লা ম্যাডাম ছেলেমেয়েদের দিকে তাকালেন। বাচ্চাদের আনন্দ, তাদের উদ্যম, কিছু দেখানোর ইচ্ছা দেখে তার চোখ জ্বলে উঠল। সন্তানের হাসিখুশি জীবন দেখে সব বাবা-মা খুশি হলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুখু নামের ছেলে
পরবর্তী নিবন্ধবিদ্রোহী কবি নজরুল