পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, ‘আল্লআজীনা আনআমাল্লাহু আলাইহিম মিনান্নাবীয়েনা ওয়া সিদ্দীকিনা ওয়াসসোহাদা ওয়ছছলেহীনা’ অর্থাৎ– যাদের প্রতি আল্লাহ পাক অনুগ্রহ করেছেন, তাঁরা হচ্ছেন, নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সৎকর্মশীল সালেহীন। আল্লাহর দরবারে মকবুল উপরোক্ত লোকদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তর নবীগণের।
অত:পর নবীগনের উম্মতদের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী তারা হলেন সিদ্দীক। যাদের মধ্যে রূহানী ও কামালিয়াতের পরিপূর্ণতা রয়েছে সাধারণ ভাষায় তাদেরকে আউলিয়া বলা হয়। আর যারা দ্বীনের প্রয়োজনে স্বীয় জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন তাদেরকে বলা হয় শহীদ। আর সালেহীন হচ্ছেন যারা ওয়াজিব–মুস্তাহাব ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে শরীয়তের পুরোপুরি অনুসরণ ও আমলকারী। তাদেরকে দ্বীনদারও বলা হয় (তাফসীরে মাআরেফুল কোরআন, পৃষ্ঠা নং–০৮)।
ইসলামের আবির্ভাব পরবর্তী হযরত মোহাম্মদ (স.) এর জামানার পর বিশ্বব্যাপি ইসলামের আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ক্রমানুসারে অবদান রাখেন সাহাবীগণ, তাবেঈগণ, তাবে–তাবেঈগণ। এরপর মুখ্য ভুমিকা রাখেন আউলিয়াগণ। আখেরী নবীর তিরোধানের পর নবুয়তের দরজা বন্ধ হলেও আল্লাহ পাক নেককার বান্দাদের জন্য বেলায়াতের দরজা ঊন্মুক্ত করে দিয়েছেন তিনি তাঁর মনোনীত মকবুল বান্দাগণকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন। এ সমস্ত বেলায়েতধারী সুফি অলি দরবেশ আউলিয়াগণ বিশ্বের যে সকল স্থানে তৎকালীন সময়ে ইসলাম পৌঁছায়নি সেসকল স্থানে নিজের ভোগ বিলাস বির্সজন দিয়ে শুধুমাত্র শান্তির ধর্ম ইসলাম প্রচারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।
আলহাজ্ব আবদুল হাকিম মাইজভাণ্ডারী(রঃ) ছিলেন একজন আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আল্লাহর অলিদের প্রায় সকল বৈশিষ্টই তার জীবনচরিতে বিদ্যমান ছিল। তিনি ছিলেন একজন মুমিন। তিনি জাগতিক দুঃখ–কষ্টের মধ্যেও আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুত হন নি। দুনিয়া হলো মুমিনের জন্য কারাগার। (সহিহ মুসলিম–২৯৫৬ ) সুতরাং কারাগার তো শান্তি কিংবা আরাম আয়েশের জায়গা নয়। এটি দুঃখ কষ্ট বেদনা যন্ত্রণার জায়গা। থাকা খাওয়ার কষ্ট, ভালো না লাগা প্রিয় মানুষ হারানোর যন্ত্রণা, নিজের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবায়ন করতে না পারার অসীম বেদনা, মনের গহিনে লুকায়িত সুপ্ত যন্ত্রণা যা হয়তো বা এ পৃথিবীর কেউ জানে না। অতএব যারা মুমিন, আল্লাহর প্রকৃত মুমিন বান্দা তাদের জন্য তো দুনিয়া কারাগার। আর কারাগার মানেই তো দুঃখ আর কষ্টের জায়গা। মুমিনের জন্য দুনিয়াতে দুঃখ কষ্ট থাকবে– এটাই স্বাভাবিক তবুও মুমিন কখনো হতাশ হবে না। মুমিন এই সমস্যাগুলোকে সাথে নিয়েই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ওপর ভরসা করে হতাশ না হয়ে আমৃত্যু জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, আর এটিই হলো একজন প্রকৃত মুমিনের বেশিষ্ট্য। আলহাজ্ব আবদুল হাকিম মাইজভান্ডারী(র.) ব্যক্তি জীবন, ব্যবসায়িক জীবন, রাজনৈতিক জীবন ও সামাজিক জীবনে অবর্ণনীয় দুঃখ– কষ্টের মধ্যে থেকেও মানবসেবা থেকে দূরে থাকেন নি।
আলহাজ্ব আবদুল হাকিম মাইজভাণ্ডারী (র.) দরবারে মুসাবিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মাইজভাণ্ডারী খলিফা মাওলানা শাহছুফি সৈয়দ আবু মুসা আহমদুল হক সিদ্দিকী আল হানাফি (র.) এর বিশিষ্ট মুরিদ ছিলেন। বায়াত গ্রহণের পর তাঁর ধর্মীয় চিন্তায়, ধ্যান–ধারণায় আমূল পরিবর্তন আসে। তাঁর স্বীয় মুর্শিদের প্রতি অগাধ ভক্তি, গভীর শ্রদ্ধা, নম্রতা, বিনয়, রিয়াজত, রিয়াছত অধিক হারে বেড়ে যায় এবং নিজের জীবনকে খেদমতগার হিসাবে মুর্শিদের চরণে উৎসর্গ করেন। আলহাজ্ব আবদুল হাকিম মাইজভাণ্ডারী (র.) এর আর্থিক অবস্থা সবসময় সচ্ছল না থাকার পরও ওরশের দিনগুলোতে নিয়মিত নজর নেওয়াজ নিয়ে মুর্শিদের দরবারে হাজির হতেন। এক ওরশের সময় আবদুল হাকিম মাইজভাণ্ডারীর আর্থিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও আবদুল হাকিম মাইজভাণ্ডারীর মন হাদিয়া সংগ্রহের জন্য অস্থির হয়ে পড়্। েঅর্থ আসবে কোন উৎস থেকে? অবশেষে মুর্শিদের মহব্বত ও সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য স্বীয় স্ত্রীর বালা বিক্রি করে মুর্শিদের দরবারে হাদিয়া নিয়ে হাজির হন। তিনি আল্লাহর নবীর জীবনচরিত অনুসারে জীবনযাপন করতেন। আগামী দিনের কথা চিন্তা না করে মানুষকে তিনি অকাতরে দান করতেন। সময়ে সময়ে অকাতরে দান করার ফলে তিনি আর্থিক কষ্টেও পড়তেন।
আলহাজ্ব আবদুল হাকিম মাইজভাণ্ডারী(র.) বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ছিলেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কাণ্ডারী। আশির দশকে আমি নগর ছাত্রলীগের নেতা থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন সময়ে প্রিয় নেতা আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরীর বিভিন্ন ম্যাসেজ নিয়ে উনার উত্তর পাহাড়তলীস্থ বাসায় যেতাম। তখন বিএনপি ঐ এলাকায় এতবেশি শক্তিশালী ছিল সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের নাম নিতেও ভয় পেতেন। ঐ সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জননেতা আবদুল মালেক উকিল চট্টগ্রামে সফরকালীন সময়ে উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সৌভাগ্যবশতঃ প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন এবং কাউন্সিল অধিবেশন শেষে আলহাজ্ব আবদুল হাকিম মাইজভাণ্ডারী (র.) কে সভাপতি ও আবদুর রহমান বিশ্বাসকে সাধারণ সম্পাদক করে উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটি ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় সভাপতির মাধ্যমে সভাপতির দায়িত্ব পাওয়া আলহাজ্ব আবদুল হাকিম মাইজভাণ্ডারী(র.) এর মত সৌভাগ্য কয়জন নেতারই বা ভাগ্যে জুটেছে। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ঐ দায়িত্বে আসীন ছিলেন।
আলহাজ্ব আবদুল হাকিম মাইজভাণ্ডারী(র.)এর ধর্মীয় ও মানবকল্যাণে কাজ করার বৈশিষ্ট্য তাঁর উত্তরাধিকারীগণের মধ্যেও বিরাজমান রয়েছে। তাঁর তৃতীয় পুত্র আলহাজ্ব মন্জুরুল আলম মন্জু চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র এবং বেশ কয়েকবার উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের নির্বাচিত কমিশনার ছিলেন। তাঁর বড় পুত্র আলহাজ্ব মো. তাহের এর এক সন্তান আলহাজ্ব দিদারুল আলম দুই দুইবার সীতাকুণ্ড নির্বাচনী এলাকা থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত সংসদ সদস্য। তাঁর অপর এক নাতি টিপু ভাই মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের অন্যতম প্রাণপুরুষ হযরত সৈয়দ গোলামুর রহমান (ক.) মাইজভাণ্ডারীর নাতি হযরত সৈয়দ সামশুদ্দোহা (ক.) মাইজভাণ্ডারীর ট্রাস্টমূলে দরবারের খেদমতগার হিসাবে নিয়োজিত আছেন।
অপরাপর আওলাদগণ ও আলহাজ্ব মোস্তফা–হাকিম ফাউন্ডেশন ও হোসনে আরা–মন্জু ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট পরিচালিত ৯০টিরও বেশি ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজসেবায় নিয়োজিত আছেন। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি আশেকে রাসুল (স.) এবং আশেকে অলিআল্লাহ আলহাজ্ব আবদুল হাকিম মাইজভাণ্ডারী(র.) ওফাত লাভ করেন। মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রামে। ঘর থেকে ঘরে। আশেকদের অন্তর থেকে অন্তরে। আলহাজ্ব মোস্তফা হাকিম ডিগ্রী কলেজের পাশেই তার মাজার শরীফ রয়েছে। প্রতি বছর তাঁর ওরশ শরীফ পলিত হয়। এবছরের ওরশ শরীফে আওলাদে রাসুল, আওলাদে গাউছুল আযম দস্তগীর হযরত আল্লামা শাহছুফী সৈয়দ আফিফ উদ্দীন জিলানী ( ম.জি. আ.) প্রধান মেহমান হিসাবে উপস্থিত থাকবেন। লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ।