জাতিসংঘভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় উন্নয়ন স্তরের এক অভিধা থেকে আরেক অভিধায় উত্তরণ যেকোনো রাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও বিশ্বদরবারে বিশেষ মর্যাদার পরিচায়ক। সর্বজনীনভাবে এটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সত্য। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে আমাদের দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত ছিল। ২০১৮ সালে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা-এ তিনটি সূচকে নির্ধারিত মান পরিপূরণ করে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণের প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে। জাতিসংঘের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিপিডি) মানদণ্ড অনুযায়ী, তিনটি সূচকের মধ্যে যেকোনো দুটি সূচকে নির্ধারিত মান অর্জন করলে কোনো স্বল্পোন্নত দেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে প্রাথমিকভাবে যোগ্য বিবেচিত হয়। এর আগে কোনো দেশই একযোগে তিন সূচকে আবশ্যকীয় মান অর্জন করতে পারেনি। বাংলাদেশই কেবল এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। নিঃসন্দেহে জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য আনন্দের ও গৌরবের। সূচকগুলোর অর্জিত অগ্রগতির ধারা বজায় থাকলে ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের প্রবেশ ঘটবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। তাই সামনের বছরগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাস্তবতা হলো, বর্তমানে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও দেশীয় পরিবেশ পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য খুব একটা অনুকূল নয়। বিশেষ করে কভিড-১৯ মহামারীতে আমাদের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। যথাসম্ভব দ্রুত অর্থনীতি পূর্ণমাত্রায় ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে টেকসইভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ আমাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। বৈশ্বিক পর্যায়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের কিছু সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ আছে। যেমন বাংলাদেশ এখন এলডিসি হিসেবে যেসব বাণিজ্য সুবিধা পায়, উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হওয়ার পর সেগুলো পাবে না। এখন যে রেয়াতি সুদের ঋণ পায়, তা আর পাবে না, উচ্চসুদে ঋণ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক সুবিধা, মেধাস্বত্ব সুবিধা ইত্যাদি কমে যাবে কিংবা প্রত্যাহার হবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ আরো প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে। বিশেষ করে শুল্ক ও মেধাস্বত্ব সুবিধা প্রত্যাহারজনিত কারণে দেশের পোশাক ও ওষুধ শিল্পে বিপুল নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বলা চলে, রফতানি খাতের আঘাত মোকাবেলা করা সহজ নয়। দেখা গেছে, উল্লিখিত বিষয়গুলোর কারণে অনেক দেশ এলডিসির তালিকা থেকে যাওয়ার পর সমস্যায় পড়েছে। তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমেছে, রফতানি ও বিদেশি সহায়তা কমেছে। বিরাজমান প্রতিকূল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সঙ্গত কারণে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও আগের সুবিধাগুলো পাওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের আশা, নির্ধারিত সময়ে দেশের উত্তরণও ঘটুক, আবার সুবিধাগুলোও আরো কিছু সময় বজায় থাকুক। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিধি ব্যবস্থা অনুযায়ী উত্তরণের পর সেগুলো বজায় রাখা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায় বৈ কি। কভিড-১৯ মহামারী কেবল দারিদ্র্য, অসমতা ও কর্মচ্যুতির মতো অর্থনীতির নাজুকতাগুলো তীব্রতর করেছে তা নয়; বিবেচ্য সূচকগুলোয়ও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। সুনির্দিষ্ট বললে, চলমান অতিমারীর কারণে মানবসম্পদ সূচকের গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের আরো অবনমন ঘটবে। জিডিপি অনুপাতে অপ্রতুল বাজেটারি বরাদ্দে আমাদের স্বাস্থ্য খাত আগে থেকেই দুর্দশাগ্রস্ত। এখন এ দুর্দশা আরো বেড়েছে, বাড়বে। সংক্রমণ পরিস্থিতির বিরাজমানতায় সামনে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসের আগের অর্জন ম্লান হতে পারে; যেহেতু সংক্রমণের ভয়ে ঘরে অনিরাপদ প্রসব বাড়ছে এবং পাঁচ বছর বয়সী শিশু ও নবজাতকরা পুষ্টি ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর পরিণাম পুষ্টিহীনতা, খর্বকায়ত্ব কৃশকায়ত্ব এবং দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা। সমরূপভাবে, দারিদ্র্যের মাত্রা বাড়ায় শিক্ষা খাতে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে মাধ্যমিকে প্রবেশ হার কমবে। বাল্যবিবাহ বেড়ে লৈঙ্গিক সমতা সূচকেও অবনমন ঘটবে। মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রেক্ষিত থেকে যার বিরূপ প্রভাব বিপুল। অন্যদিকে কভিড-পরবর্তী ধাপে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত নাজুকতা সূচকের আটটি নির্দেশকের মধ্যে সেবা ও পণ্য রফতানিজনিত অস্থিতিশীলতা এ দুটি নির্দেশক বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
এলডিসি থেকে বিশ্ববাজারে পণ্য ও সেবা উভয়ের চাহিদা দমিত হওয়ায় বাংলাদেশের রফতানি আয়ও রেমিট্যান্সের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আরো গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্ব অর্থনীতি প্রলম্বিত মন্দায় নিপতিত হলে পণ্য ও জনশক্তি রফতানি যে নিকট ভবিষ্যতে অস্থিতিশীল থাকবে, সেটি অনুমেয়। এ অবস্থায় উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পথটি মসৃণ হবে না। এ জন্য বিশেষজ্ঞরা উত্তরণের সময়সীমা বাড়িয়ে নেয়ার কথা বলছেন। এটি আমলে নেয়া যেতে পারে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের কারণে দেশের উন্নয়ন ধারাবাহিকতায় হঠাৎ করে যেন ছন্দপতন না ঘটে, সেজন্য সম্ভাব্য প্রভাবগুলো বিবেচনায় নিয়ে সর্বাগ্রে একটি সুপরিকল্পিত ও বাস্তবসম্মত উত্তরণ কৌশল নেয়া জরুরি। আলোচ্য কৌশলের আলোকে উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে এখন থেকে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক সাপোর্ট মেজার্স (আইএসএম) আরো কিছু সময় বাড়াতে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো আঞ্চলিক সংঘের সঙ্গেও মিথস্ক্রিয়া বজায় রাখা চাই। এক্ষেত্রে ভুটান, লাওস, মিয়ানমার, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, কিরিবাতি ও টোভালুর মতো দেশগুলো কী ধরনের নীতি ও পরিকল্পনা করছে, সেগুলো অনুসরণপূর্বক কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বোপরি প্রয়োজন প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো। রফতানি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা না বাড়লে বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দৃঢ় অবস্থা সম্ভব নয়, আবার সেগুলো চিরদিনের জন্য থাকবেওনা। এ বাস্তবতা মেনে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য অর্থনৈতিক কাঠামোগত রূপান্তর ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বেগবান করতে হবে, রফতানির ও প্রাতিষ্ঠানিক ঝুড়ি বৈচিত্র্যময় করতে হবে, মানবসম্পদের গুণগত মান বাড়তে হবে, বিনিয়োগের জন্য ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোর আরো উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা।