অনশ্রু ঈশ্বর

কাজী লাবণ্য | সোমবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:৫৪ পূর্বাহ্ণ

মন থেকে সব দ্বিধাসংকোচ আর ব্যথার গুরুভার ঝেড়ে ফেলে দিল হীরা। মুখ তুলে তাকাল আবার আকাশের দিকে, দল ছাড়া একটি শকুন পাক দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শূন্যে। টুকরোটুকরো মেঘগুলো সেঁটে আছে আকাশের গায়ে, ঘোড়া, হাতি আর দু তিনতলা বিল্ডিং হয়ে। আপন মনে নানা কথা ভাবতে ভাবতে রাস্তার ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে এই জায়গায় এসে একটা বড় শিশুগাছের শেকড়ের কাছে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। সে একা, ভীষণ একা। তার কোথাও যাবার তাড়া নেই। এদিকটা জনবিরল মাঠ। দূরে দূরে কিছু গরু ছাগল চড়ে বেড়াচ্ছে। ঘন সবুজ হয়ে বিছিয়ে আছে ঘাস। জায়গায় জায়গায় ঘন ঝোঁপঝাড়। সেখানে নাম না জানা কত কত ফুল। কী তাদের রঙ! কী বাহার! তবে একটা ফুল সে খুব ভালো করেই চেনে, লম্বা লম্বা পাতার মাঝখানে টুকটুকা লাল রঙয়ের, এটা শটির ফুল। আগে জঙ্গল থেকে এই গাছের মূল তুলে নিয়ে মাকে দিলে মা সেটা কিভাবে যেন রান্না করে সবাইকে খাওয়াত।

এসব মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য বা শোভা ওর মনে ভালোলাগা তৈরি করলেও তেমন করে সাড়া ফেলতে পারে না। সম্ভব হয় না। যে সামাজিক পরিবেশ ও দাসত্ব গন্ডির মধ্যে বংশানুক্রমিকভাবে সে বড় হয়েছে তাতে সে বোঝে জগতের সকল সৌন্দর্য উঁচুজাতের মানুষের জন্য। কেবল কি সৌন্দর্য! মায়া, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা, সবরকম ভালো জিনিস, উঁচুতলার মানুষদের জন্য। তা থাকুক তাদের জন্য সে কারণে হীরার মনে কোনো রাগ বা হিংসা নাই, কেবল তাদের জন্যও সামান্য কিছু যদি থাকত। একেবারে থাকবে না এটা জগতের কেমন নিয়ম! যা মানা কষ্টকর। তখন সত্যিই মনে হয় ওই যে আকাশের পারে ঈশ্বর থাকেন তিনি কি কেবল উঁচুতলার ঈশ্বর! তিনি থাকেন কোথায়! তাকে কী নামেই বা ডাকা যায়!

()

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে মায়ের তাগিদে হীরা স্নান সেরে কাচা জামা কাপড় পরে তৈরি হয়ে নেয়। হীরার চেহারা সুরত ভালো, যা কিছু ঘটুক সে আনন্দে কাটায় বলে কিনা তার চেহারায় একটা টলটলে ভাব আছে। একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে কাপড় চোপড় পরলে তাকে ওর মায়ের ভাষায় ‘ভদ্দর নোক’ এর মত দেখায়। মা পঞ্চা কাকার দোকান থেকে মিঠাই এনে রেখেছে। যমুনার চাকরি হয়েছে। পার্মানেন্ট চাকরি, সরকারি চাকরি। সেই খুশির সংবাদ দিতে আর বউ নাতিকে আনতে মায়ের এই আয়োজন। হীরা, খুশি মনে মিঠাই নিয়ে রংপুরে শ্বশুরবাড়ি যাবার জন্য প্রস্তুত। কতদিন হয় ছেলেকে দেখে না!

বোবা বোনটার অকাল মৃত্যুর পর মায়ের উপর রাগ করে যমুনা ছেলেকে নিয়ে সেই যে বাপের বাড়ি গেছে আর আসেনি। হীরা কি করবে! সে বউয়ের মতো অতশত ঠিক বোঝে না। মধুবু মরে গেছে তাতে মায়ের কি দোষ! বউ যে কি কি সব মনে মনে ভাবে আর ফুঁসতে থাকে। এমনিতে বউ খুব মিষ্টভাষী, হাসিখুশি মেয়ে আবার বুদ্ধিও খুব। কিন্তু মধুবুর মৃত্যু সে কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না।

কমবয়সী মেয়ে আবেগ বেশি একথার চেয়েও বড় সত্যি সে প্রকৃতপক্ষে চেয়েছিল মধুবুর বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসুক, সেও মা হোক, আর সবার মতো তার সংসার তো হবে না, অন্তত মায়ে পোয়ে বেঁচে বর্তে থাকুক। বোবা, দুঃখী মেয়েটার একটা অবলম্বন হোক। মানুষ কি অবলম্বন ছাড়া বাঁচতে পারে! যমুনা বিশ্বাস করে একদিন না একদিন ওর চাকরি হবে, তখন সে মধুর বাচ্চাকে লালন পালন করতে পারবে। কিন্তু এই অসহায় বোবা মেয়েটাকে ওর মাইই মেরে ফেলল। সে নিজের মনে শাশুড়ির চলাফেরা, আচরণ, মাসির সাথে ফুসফুস, গুজগুজ ইত্যাদি অংক মিলিয়ে বুঝে ফেলে যে কি সব গাছ গাছড়া দিয়ে মধুর বাচ্চা নষ্ট করা হয়েছে আর ফলশ্রুতিতে মধু জীবন দিয়েছে।

এই মৃত্যুর জন্য সে সম্পূর্ণরূপে শাশুড়িকে দায়ী করে। সে জানে মাই তার মেয়েকে খুন করে ঝামেলা মিটিয়েছে। সে মানতে পারে না, কিছুতেই এই ঘটনা মানতে পারে না। ভাবে, মধুবুর তো কোনো দোষ ছিল না, তাকে কেন জীবন দিতে হলো!

হীরা মুখ বুজে নিজের কাজ করে আর বাকি সময়টা ছেলের সাথে কাটাতে পছন্দ করে। আজ কতদিন হয় বউ ছেলে ঘরে নাই। ওর ভালো লাগে না। ঘর একদম খালি। মধুবু নাই, বাপো নাই। তারা তো দুনিয়া ছেড়েই উই আকাশে চলে গেছে। এদিকে যমুনা আর গুড্ডুও নাই। মা নাতিকে গুড্ডু বলে ডাকতে ডাকতে ওর নাম গুড্ডুই হয়ে গেছে।

আজ ছিল ছুটির দিন, সে সারাদিন কাটাত ছেলের সাথে। ছেলে এখন পা পা করে কোমরের কালো সুতায় বাঁধা ঘুঙুরের দানা বাজিয়ে টলোমলো হাঁটে। খইয়ের মতো সাদা দাঁত দুটি বের করে হাসে, ব্বা ব্বা বলে হীরার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ওর যেমন খুশি লাগে তেমনি অবাক লাগে। ওর ইচ্ছে করে দিনরাত ছেলের সাথে কাটাতে। তা তো আর সম্ভব হয় না। হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষে সে আবার ব্যারাকের টাট্টিখানা পরিষ্কার করতে যায়। দেরি হলে তারা রাগারাগি করে। বিশেষত এক মোটা হাবিলদার আছে সে সামান্য এদিক ওদিক হলেই হুংকার ছাড়ে

আরে ওই ধাঙড়ের বাচ্চা! নবাবজাদা হইছিস! তোর এত দেরি! শালা নিজে তো গুয়ে মুতে থাকিস, আমরাও থাকব নাকি! নে নে জলদি কর। সারি সারি টাট্টিখানা দ্রুত হাতে পরিস্কার করে ফিনাইল ছিটিয়ে সে বেরিয়ে আসে। আসার পথে কারো সাথে দেখা হলে তারা নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত সরে যায় আর মুখে বলে হেই! হেই! সর! সরে যা! হীরা দ্রুত পথের কিনারে সরে যায়।

বাস থেকে নামিয়ে দেবার পরে হীরা এসে বসে পড়ে একটি খোলা প্রান্তরে। সে এই পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা নিচুজাতের একজন হয়ে জন্মগ্রহণ করে বেড়ে উঠেছে তীব্র অভাব, কোন্দল, জীর্নতা আর মানুষের বর্জ্যের মধ্যে। একটা শুকরছানা আর হীরার বেড়ে ওঠার মধ্যে কি কোনো তফাত আছে? কিছুটা বড় হওয়ার পর থেকেই বাপো তাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দিয়েছে আর সে ঘার গুজে সেসব করে গেছে।

রিকশা ঠেলা, মাছবাজারে কাজ, রেলের ভাঙ্গাচোরা লোহার টুকরো কুড়ানো, সিনেমা হলের টিকেট ব্লাকে বিক্রি সবই করেছে সে। ওর বাপো কখনই ওদেরকে স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করে নাই। কারণ বাপো জানতো স্কুলে গেলে শ্রেণীকক্ষ থেকে ওদেরকে বের করে দেওয়া হয়। কোথাও ওদের কোনো ঠাই নাই, জায়গা নাই। ঠিক আজকের দিনের মতো।

ওরা বেশিরভাগ সময় লক্কর ঝক্কর মার্কা মুড়ির টিনের মতো বাসে বা লোকাল ট্রেনে সব জায়গায় যাতায়াত করে। আজ হঠাত কি মনে করে সে স্বাভাবিক বাসে উঠে পড়েছিল। ভাবছিল তাড়াতাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি ওদেরকে নিয়ে ফিরে এসে সে ব্যাটার সাথে খেলবে। বাস কিছুদূর চলার পরেই সহযাত্রীর নানা প্রশ্নের জবাবে বেরিয়ে পরে ওর আসল পরিচয়। সহজ সরল হীরা পরিচয় গোপন করার কথা ভাবেনি।

এক কথায় দু’কথায় সহযাত্রীরা মারমুখী হয়ে ওঠে। একেকজন নানা মন্তব্য, গালাগালি, রাগারাগি শুরু করে। বাকি বাসভরা মানুষ কোনো কথা বলে না চুপ করে থাকে। ওর খুব অবাক লাগে একজন মানুষও ওর পক্ষ নিয়ে একটা কথা বলল না। বলল না, ‘ও একজন মানুষ’। কেবল ধাঙড় পরিচয় নয়, ঈশ্বর ওকে মানুষের ঔরসে, মানুষের পেটে, একজন মানুষ হিসেবেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। যাত্রীরা আরো বেশি ক্রোধান্বিত, উত্তেজিত হয়ে উঠলে, বাস থামিয়ে হেল্পার ওকে মৃদু ধমক ধামক দিয়ে নামিয়ে দেয়। অবশ্য নামার পরে হেলপার কানে কানে বলে ‘ভাইরে কী দরকার ভদ্দরলোক হবার’! এরা উঁচুজাতের মানুষ, তুই যা তাই থাক না।

এইবার হীরার বুক ফেটে কান্না আসে। সে মেথর। সে ধাঙড়। সে অচ্ছুৎ, তাই সই। সে ভদ্দরলোক হতে চায়নি। কেবল খানিকটা সময় বাঁচাতে চেয়েছিল। সে তো অপরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠেনি। আজ সে সাবান ডলে চান করেছে। মা পরিষ্কার কাপড় দিয়েছে, সেটাই পরেছে।

এই জীবন আর ওর ভালো লাগে না। ওর বাবাকে দেখেছে কিভাবে মানুষের জুতার তলার ধুলোমাটি হয়ে বেঁচে থাকতে। বাবা দেখেছে তার বাবাকে, তিনিও দেখেছেন তার বাবাকে। সে নিজেও সেই জীবন কাটিয়ে যাচ্ছে আবার ওর ছেলেটাও এমন জীবন কাটাবে! মানুষের পায়ের জুতার ধুলো হয়ে, গু মুত পরিষ্কার করবে! মানুষ ওকে কুকুর বেড়ালের মতো দূর, ছেই করবে! ওও হবে নিচু, অচ্ছুৎ জাতের! মনুষ্য অবয়বটাই কেবল থাকবে কিন্তু মনুষ্য স্বীকৃতি পাবে না!

হীরার বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে। নিজের অজান্তে সে তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে-‘না! না!…হঠাৎ করে সে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। ঠিক ওর ছেলের মতো। শুয়ে সে অক্ষম ক্ষোভে দুঃখে ফোফাতে থাকে। একটানা সে অনেকক্ষণ এমনি উপুড় হয়ে থাকে।

হীরা জানে না, ‘বিলাভড’ উপন্যাসে সেথ নামের এক নারী ক্রীতদাসত্বের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নিজের সন্তানকে হত্যা করেছিলেন। টনি মরিসন এউপন্যাস লিখেছিলেন ১৯৮৭ সালে।

হীরার মনে কী সেরকম কিছু ইচ্ছে ডানা মেলতে থাকে! বিকেলটা সন্ধ্যার বুকে সেঁধিয়ে গেলে, তিলেক দেরি না করে আস্তে আস্তে উঠে মিঠাইয়ের ঠোঙাটা একটা ঝোঁপের মধ্যে রেখে সে হাঁটা শুরু করে। বড় বড় আকারের সাদা মেঘ হেলেদুলে হাঁটছে আকাশে। আর হীরা হনহন করে হাঁটছে সন্তানের মুখ মনে করে।

ছায়াছায়া অন্ধকার নেমে আসছে পৃথিবীর উপর। যেন অনন্ত এক নৈঃশব্দ্যর পাথর পিষে ফেলছে সমস্ত কোলাহল।

অন্ধকার শহরে রাস্তার আলোরা জ্বলে উঠছে দ্যুতিহীন। লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে চলেছে একজন অচ্ছুৎ, একজন না মানুষ, একজন পিতা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধবারমুডার রহস্য