হাজার টাকা বিনিয়োগ করে এক রাতের ব্যবধানে মিলেছে ৫৫ হাজার টাকার জ্যাকপট। একাধিক মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট নম্বর ব্যবহার করে সেই টাকা সকাল হওয়ার পূর্বেই এসেছে নগরীর পূর্ব নাসিরাবাদ এলাকার এক যুবকের পকেটে। ওই যুবক প্রথমবার ভাগ্যবান হলেও অনলাইন জুয়ার সাইট বা অ্যাপের মাধ্যমে এমন বিনিয়োগে প্রতিদিন কোটি টাকা হারাচ্ছে নগরীর হাজারো বিভিন্ন বয়সের জুয়াড়িরা। বিগত ২/৩ বছর ধরে বিভিন্ন দেশ থেকে এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালিত অনলাইন জুয়ার বিস্তার হয়েছে মাকড়সার জালের মতো। ইতোমধ্যে অনলাইনে জুয়া খেলা নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন আইন চেয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। জুয়া প্রতিরোধে নতুন ‘জুয়া আইন, ২০২৩’ এর খসড়া করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এক ধরনের কৌতূহল থেকে তরুণ প্রজন্ম আকৃষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন জুয়ার সাইটে। হাজার টাকার বিনিয়োগে শুরু করে লোভে পড়ে একপর্যায়ে খোয়াচ্ছে লাখ লাখ টাকা। জুয়ার এসব সাইটের অধিকাংশ পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে। বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব সাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশের এজেন্টরা। লেনদেনের সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস)। মাঝে মাঝে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট ও জুয়া পরিচালনাকারীদের ধরলেও একেবারে বন্ধ করা যাচ্ছে না অনলাইন জুয়া।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অনলাইন জুয়া নির্মূল করার জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা। প্রযুক্তির পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি করে বন্ধ না করলে অনলাইন জুয়া নির্মূল করা যাবে না। যে নিঃস্ব হওয়ার জন্য জুয়া খেলবে, তাকে নিষেধ করে আপনি কী করবেন? তিনি বলেন, র্যাবের সাইবার মনিটরিং সেল ও গোয়েন্দা শাখা এ ব্যাপারে সার্বক্ষণিক নজরদারি করছে। এরইমধ্যে বেশকিছু মাস্টারমাইন্ড পর্যায়ের জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অনলাইন মনিটরিংয়ের মাধ্যমে।
কয়েকজন অনলাইন জুয়াড়ির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে তিনভাবে জুয়া খেলা হচ্ছে। প্রথমত. একসঙ্গে কোনো দোকান, সেলুন, হোটেল বা ঘরে বসে জুয়া খেলে। এরা বাজির টাকা নগদ হাতে হাতে পরিশোধ করে। দ্বিতীয়ত. বাড়ি, অফিস বা অন্যত্র বসে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পরিচিতদের সঙ্গে বাজি ধরা। তৃতীয়ত. অ্যাপের মাধ্যমে। এরা টাকা লেনদেন করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। এ খেলায় সক্রিয় আছে দালালচক্রও। তারা জুয়াড়িদের পাশে বসে থাকবে, প্রয়োজনে টাকা ধার দেবে। বিনিময়ে পাচ্ছে লভ্যাংশও।
জুয়া খেলা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে বাংলায়। অনলাইন ক্যাসিনোর অ্যাপ ইনস্টলের জন্যও দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন অফার। অনুসন্ধানে জানা যায়, সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে এই অনলাইন ক্যাসিনো। তবে এসব ক্যাসিনোর মালিক কারা বা কোথা থেকে পরিচালিত হচ্ছে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কোনো তথ্য নেই। কয়েকটি ক্যাসিনোর ফেসবুক পেজে দেওয়া রয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর। এগুলোতে যোগাযোগ করেও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বরং টাকার বিনিময়ে গ্রুপের সদস্য হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে। চাওয়া হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, নাম, বয়স, জন্ম তারিখ ও মোবাইল নম্বর। এসব তথ্য দিলেই মেলে গ্রুপের সদস্য হওয়ার অনুমতি। অনলাইনে জুয়া খেলা নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন আইন চাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। সর্বশেষ পুলিশ সপ্তাহে এই নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা বলেন, প্রকাশ্যে সরঞ্জামাদি ব্যবহার করে জুয়া খেলা হলে ১৮৬৭ সালের পাবলিক জুয়া আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু অনলাইনে জুয়া খেলা হলে এই আইনে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। তাই অনলাইনে জুয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন আইন চান পুলিশ কর্মকর্তারা।
অবশ্য এর আগেই নতুন ‘জুয়া আইন–২০২৩’ এর খসড়া করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। মূলত ১৮৬৭ সালের ‘দ্য পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট’ যুগোপযোগী করে নতুন আইনটি করা হচ্ছে। নতুন আইনে অনলাইন জুয়া অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। খসড়া আইনে জুয়ার শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। আগের আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল ৫০০ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের জেল।
জননিরাপত্তা বিভাগের আইন ও শৃঙ্খলা অণুবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান জুয়া আইনটি দেড়শ বছরেরও বেশি পুরোনো। এ আইন দিয়ে হাল আমলের জুয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। কারণ এখন জুয়ায় তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়টি যুক্ত হয়েছে, যা আইনের আওতাভুক্ত নয়। একইসঙ্গে শাস্তিও খুবই কম। তাই জুয়ার আধুনিক পর্যায়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নতুন আইন করা হচ্ছে। একইসঙ্গে শাস্তিও কয়েকগুণ বাড়ানো হচ্ছে।