বাংলাদেশের প্রাণ বঙ্গবন্ধু : যাঁর অবদান গগনচুম্বী

| রবিবার , ১৭ মার্চ, ২০২৪ at ৪:৫৫ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী আজ। সরকারিভাবে দিবসটিকে উপলক্ষ করে উদযাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। উদযাপিত হবে জাতীয় শিশু দিবস।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তাঁর জন্ম। মধুমতির তীরছোঁয়া সবুজ শ্যামল এ গ্রামে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মাবাবা আদর করে তাঁকে ডাকতেন ‘খোকা’। সেই ছায়াঘেরা গ্রামে শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশব কাটে অত্যন্ত দুরন্তপনায়। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে সাঁতার কাটা, দল বেঁধে হাডু ডু, ফুটবল, ভলিবল খেলায় তিনি ছিলেন অগ্রণী। কখনো কখনো হয়ে উঠতেন দস্যি কিশোর। তখন কে জানত, এই দস্যি কিশোরই হয়ে উঠবেন বাঙালি জাতির পিতা? সেই দস্যি কিশোর শেখ মুজিব হবেন বিশ্বনেতা। বাঙালি জাতির ইতিহাসে তাঁর অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়ে তিনি জাতির জনকে ভূষিত হয়েছেন। এদেশের মানুষকে ভালোবেসেছেন বলে তাঁরাই উপাধি দিয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু।’

একজন ছাত্রকর্মী থেকে স্বাধীন দেশের স্থপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে তাঁর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এসেছে বাধা, এসেছে প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু সমস্ত বাধা অতিক্রম করে তিনি পৌঁছে গেছেন তাঁর গন্তব্যে। সঙ্গে ছিল জনগণের ভালোবাসা। ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান পুরো মাত্রায় রাজনীতি নেতৃত্বে নেমে পড়েন। চোখের সামনে যা কিছু অন্যায়, বঞ্চনা ও শোষণ দেখতে পেয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন অকুতোভয়ে। কিশোর বয়স থেকে তাঁর বুকে যে দ্রোহের আগুন জ্বলছিল, তা আরো প্রগাঢ় হয়ে ওঠে। কারা লুটেপুটে খায় বাংলার সম্পদ? কারা কেড়ে নেয় বাংলা মায়ের সুখ ও শান্তি? শৃৃঙ্খলিত স্বদেশভূমিকে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করার দুর্জয় শপথ নিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পুরো জাতিকে জাগিয়ে তুললেন। বাংলার মানুষের জন্যে তাঁর আন্তরিক দরদ ও উদারতা রূপ নিয়েছে কিংবদন্তিতে।

শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। কেন চাইলেন এই স্বাধীনতা? অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ বলেন, খোকা যেমন মাকে চায়, আকাশ যেমন নীল চায়, আর বসন্ত যেমন গান চায়। মুজিব তেমনি স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। মায়ের মতো স্নিগ্ধ যে দেশ সেই দেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন সর্বক্ষণ। মুজিবের এই স্বাধীনতা চাওয়ার জন্য তাঁকে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। কারাবাস করতে হয়েছে বারবার। অনেকবার। সকালে গ্রেফতার করলে বিকেলে ছাড়ে। আবার বিকেলে করলে পরের দিনও ছাড়ে। কখনো দীর্ঘদিন। হিসেব করে দেখা গেল জীবনের চৌদ্দ বছর কাটলো তাঁর কারাগারেই। মৃত্যুর হাত থেকেও ফিরে এসেছেন তিনি। নিশ্চিত মৃত্যু। ফাঁসি তৈরি। ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে এটি বিবেচিত। বাংলার ভালোবাসা মুজিবকে বাঁচালো। আবার মুজিব এসে বাংলাকে মুক্ত করলেন।

১৯৬৯ সালে পূর্ব বাংলায় গণজোয়ার সৃষ্টি হল। সৃষ্টি হলো গণঅভ্যুত্থান। সেই সময় হাজার কন্ঠে উচ্চারিত হয়: ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর,’ ‘আমাদের সংগ্রাম চলছেই চলবে।’ এসব স্লোগানের সঙ্গে আরেকটি স্লোগান শোনা যেত; ‘এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।’ হ্যাঁ বঙ্গবন্ধুই নেতা, যিনি গোটা বাঙালি জাতির মুক্তির দিশারী। তিনিই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলার মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে আহবান জানালেন। ডাক দিলেন স্বাধীনতার। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। এই আন্দোলন ছিল বহু বিজ্ঞ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। এই আন্দোলন চালিয়ে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান চক্রকে অসহায় করে তুলেছেন যেমন, তেমনি বিশ্ববাসীর কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, বাঙালি শান্তিপ্রিয় জাতি। পাকিস্তানিদের যাবতীয় শোষণ, অত্যাচার, অবিচার ও নির্যাতনের জবাব দিচ্ছে রক্তপাতহীন, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন দিয়ে। এই আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। এই আন্দোলনের মুখে বিপর্যস্ত পাকিস্তানি চক্র ২৫ মার্চ রাতে শেষ পর্যন্ত কামান বন্দুক নিয়ে বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নৃশংসতম হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে তারা। বঙ্গবন্ধুর ডাকে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ। দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙালি দেখাতে পেরেছিল তাদের সাহস ও শক্তিমত্তা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১এ লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিতাড়িত হলো পাকিস্তানি বাহিনী। পৃথিবীর বুকে জন্ম হলো নতুন একটি দেশ ‘বাংলাদেশ’। তাই বঙ্গবন্ধু শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি আন্দোলন। একটি প্রতিষ্ঠান। একটি বিপ্লব। একটি অভ্যুত্থান। জাতি নির্মাণের কারিগর। মহাকালের অমরগাথা। একটি স্বাধীন দেশ। একটি ইতিহাস।

কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য! দেশিয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকে বেশিদিন বাঁচতে দেয়নি। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করলো। যে হত্যাকাণ্ড বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংসতম বলে চিহ্নিত। তবে তাঁর এ মৃত্যু বীরের মৃত্যু। যীশুখ্রিস্টের মত। মহাত্মা গান্ধীর মত। ঘাতক তাঁর শরীরকে বিদ্ধ করলেও হরণ করতে পারেনি তাঁর আত্মমর্যাদা। হরণ করতে পারেনি তার বাঙালি সত্তার পূর্ণতার। বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। এই বাংলাদেশ যতদিন টিকে থাকবে, তিনি জীবিত থাকবেন ততদিন। তিনি আবহমান বাংলার চিরকালের প্রাণ প্রবাহ। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর ভাষায়, ‘বাংলার পাখির গানে, নদীর কলতানে, বাতাসের উচ্ছ্বাসে, আকাশের গরিমায়, সূর্যের শৌর্যে, চাঁদের কিরণে, নক্ষত্রের ছায়াপথে, ভোরের শিশিরে, মসজিদের আযানে, মন্দিরের কাঁসরধ্বনিতে, গির্জার ঘণ্টায়, জারি সারি ভাটিয়ালী সুরে, বসন্তের উল্লাসে, বর্ষার ক্রন্দনে, শরতের শ্যামলিমায়, বৈশাখের ভৈরবীতে, বাঙালির হাসিকান্না, প্রেমভালোবাসা, মিলনে বিরহে তিনি চিরদিনের জন্য চিরকালের জন্য জাগ্রত, জীবন্ত। তাঁর মৃত্যু হয়নি।’ তিনি অমর। তিনি আমাদের প্রেরণা। তিনি বাংলাদেশের প্রাণ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনলাইন ক্যাসিনোর আশঙ্কাজনক বিস্তার
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে