অটিজম বা অটিজম স্পেকট্রাম ডিসওরডারস্ কোন রোগ নয়, এটা শিশুর স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যা। এ বিকাশজনিত সমস্যার জন্য অন্যের সাথে যোগাযোগ করা কথা বা শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যেমন পারে না, তেমনি তারা একা থাকতে পছন্দ করে, একই কাজ বারবার করার প্রবণতা থাকে, আচরণগত সমস্যা থাকে ইত্যাদি বলা যায় একদম স্বল্প কথায়। অটিজম যাদের আছে তাদের সমস্যা ভিন্ন, অনেক ক্ষেত্রেই একজনের সমস্যার সাথে অন্যজনের সমস্যার তেমন কোন মিল থাকে না। পরিসংখ্যান মতে প্রতি সাতান্নজনে একজন শিশুর অটিজম আছে, প্রতি ৪জনের মধ্যে তিনজন ছেলে, একজন মেয়ে শিশু (সিডিসি আমেরিকা ২০২০)।
আমাদের দেশেও এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধী নিবন্ধন ডাটা অনুযায়ী সারা দেশে নিবন্ধিতঅটিজমের সংখ্যা প্রায় ষাট হাজার,এ নিবন্ধন একটা চলমান প্রক্রিয়া। সত্যিকারভাবে এসংখ্যা আরও অনেক অনেক বেশি অন্যসব দেশের মতো। দিন দিন যে হারে অটিজমের সংখ্যা বৃদ্ধিপাচ্ছে তার জন্য প্রয়োজন সবাই সচেতন হয়ে অটিজমকে মেনে নিয়ে এদের জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিক্ষা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
আজ পর্যন্ত এমন কোন ওষুধ বা ব্যবস্থা নেই যা দিয়ে অটিজম নিরাময় করা যায়, কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করে যদি সঠিকভাবে, বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে, সমন্বিতভাবে পরিচর্যা করা যায়, এদের অনেকেরই অটিজম থেকে উত্তরণ ঘটে এবং একটা স্বাভাবিক স্বাবলম্বী জীবনযাপন করতে পারে। এরজন্য প্রয়োজন পারিবারিক, সামাজিক, সরকারি বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ,প্রচেষ্টা,সচেতনতা,সহযোগিতা, সহমর্মিতা, হ্রদয় দিয়ে উপলব্ধি, সঠিক এবং কার্যকরী পদক্ষেপ।
বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সুযোগ্য কন্যা সম্মানিত জাতীয় চেয়ারপারসন, এনডিডি প্রোটেকশন ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এর উদ্যোগের জন্য অটিজম এখন অতি পরিচিত একটি শব্দ, সচেতনতা যেমন বেড়েছে তেমনি এ শব্দটি নানাভাবে ব্যবহৃতও হচ্ছে যেখানে হওয়ার কথা না- যেমন কেউ কাউকে ছোট করার জন্য বা গালাগালি করার সময় বলছে’ তুই/ তুমি অটিস্টিক নাকি’!
এ ছাড়াও অটিজম নিয়ে অনেক অনেক প্রতিষ্ঠান বা স্কুল কাজকরছে যাদের মধ্যে বেশির ভাগই ব্যবসায়িক বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড়শহরগুলোতে। (সবাই নয়)।
সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান এবং হাতেগোনা বেসরকারী কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় অনেক প্রতিষ্ঠানই মানসম্পন্ন নয় এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাবা- মা তথা অভিভাবকরা তাঁদের বিশেষ সন্তানদের নিয়ে অসহায়, বিভ্রান্ত, অর্থনৈতিকভাবে, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এটাতো হলো বড়বড় শহরগুলোর অবস্থা, আর গ্রামের অবস্থা হলো অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক অসহযোগিতা, কুসংস্কার, বিশেষায়িত শিক্ষা- প্রশিক্ষণের সুযোগ না পাওয়া।
অটিজম এমন একটি সমস্যা যা শহর গ্রাম, ধনী- দরিদ্র , কালো- সাদা, ধর্ম, বর্ণ গোত্র সবার মধ্যে সমানভাবে বিরাজমান যা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উদ্ধৃত।
তাই অটিজম যাদের আছে তাদের সমাজের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার জন্য, সমাজে গ্রহণযোগ্য করার জন্য, স্বাবলম্বী করার জন্য শহর- গ্রাম সকল স্তরে সমান সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয়,একান্ত কাম্য।
প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্তকরণ, সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ, প্রতিটি সরকারি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এদের শিক্ষাপ্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ( সমন্বিত শিক্ষা)।
এর জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকদের মনমানসিকতার পরিবর্তন, অঙ্গীকার (কমিটমেন্ট) যাতে করে অন্তত এক/দুজন করে প্রাথমিক ক্লাসে প্রতিবছর অটিজম শিশু ভর্তির সুযোগ পায়, এতে করে সারাদেশের অনেক অটিজম শিশুরা যেমন মূলধারায় যাবার সুযোগ পাবে তেমনি স্বাভাবিক শিশুরা ছোটবেলা থেকেই বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের দেখে মানবিক হয়ে উঠবে, অন্যদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে, মানবিক সমাজ পাবে আমাদের দেশ; সমাজ আরও বেশি সচেতন হবে যেমন তেমন অটিজম শিশুরাও স্বাভাবিক শিশুদের সাথে অধিক মেলামেশার সুযোগ পাবে।
এর জন্য প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রয়োজন অটিজম তথা বিশেষ শিশুর শিক্ষার জন্য এবং আচরণগত সমস্যাগুলোকে সমাধানের জন্য, বিশেষ প্রশিক্ষণ যা সরকার শুরু করেছেন বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা এবং কারিকুলাম প্রণয়ন করে। আশা করি এ মানবিক কাজ এগিয়ে যাবে এবং কার্যকর হবে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং তাঁদের কমিটমিটমেন্টের মাধ্যমে।
তাছাড়া অটিজম শিশুদের উত্তোরণের জন্য প্রয়োজন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পেশাল এডুকেটর, স্পীচলেঙ্গুজ থেরাপিস্ট, বিহেবিয়ারেল থেরাপিষ্ট ইত্যাদি। এঁদের সংখ্যা খুবই নগণ্য এখনও আমাদের দেশে, তারপরও সরকার যদি উদ্যোগ নিয়ে পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অন্ততপক্ষে প্রতিটি উপজেলায় পদায়নের ব্যবস্থা করেন, বিশেষ করে অকুপেশনাল এবং স্পীচলেঙ্গুজ থেরাপিষ্টদের যাঁরা একটা নির্দিষ্ট রুটিনের মাধ্যমে পনের দিনে/মাসে/ দুমাসে একবার করে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীকে দেখে শিক্ষক অভিভাবকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ বা নির্দেশনা দেন তা হলে অনেক সমস্যারই সমাধান হবে আশা করি। এ ব্যবস্থাপনা ধাপে ধাপে সারা দেশে ছড়িয়ে যাবে, প্রতিটি শিশু সুযোগ পাবে শিক্ষার স্বাবলম্বী হবার যা তার নাগরিক অধিকার।
এখন দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রত্যেক থেরাপিস্ট বড় বড় শহরে এক একটা বিশেষায়িত স্কুল খুলেছেন বা কোন কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন, তাঁরা যে সেবা অটিজম বা বিশেষ শিশুদের দিচ্ছেন তা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি পরিপূর্ণ বা সমন্বিতও নয়, অনেকক্ষেত্রে অভিভাবকরা প্রতারিতও হচ্ছেন। আবার অনেকেই আছেন যারা সত্যিকারভাবে এ বিশেষ শিশুদের জন্য কাজ করছেন, কিন্তু সে সংখ্যা খুবই নগণ্য।
তাই এমন পরিস্থিতিতে এ বিশেষশিক্ষা প্রশিক্ষণ সত্যিকারভাবে বিশেষ শিশুদের জন্য উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা করতে প্রয়োজন সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা সঠিকভাবে কার্যকর করা প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান নির্ধারণ করে যাচাই বাছাই করা, বিশেষায়িত মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যাতে শিক্ষাকার্যক্রম চালাতে পারে সেজন্য সরকারিকরণ বা সরকারি অনুদানের সুযোগ সৃষ্টি করা যাতে করে ধনীদরিদ্র সকল স্তরের বিশেষ শিশুরাই সুযোগ পাই সেসব প্রতিষ্ঠানে।
করোনা মহামারীতে শুরু হচ্ছে নতুন বছর ২০২১ খ্রি:, করোনা মহামারী মোকাবেলায় অনেকটাই সফল আমাদের দেশ, সকলে যদি স্বাস্থ্য সচেতন হই, সকল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি একদিন করোন মহামারী চলে যাবে, সকল কাজের মতো সকলশিক্ষাকার্যক্রমও স্বাভাবিক হবে।
সকল স্বাভাবিকতার মাঝে আমাদের সকল অটিজম শিশুসহ সকল বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরাই শিক্ষাপ্রশিক্ষণের সমান সুযোগ পাবে, একীভূত হবে সমাজে, গ্রহণযোগ্যতা পাবে সমাজে, স্বাবলম্বী হবার সুযোগ পাবে সমাজে; ওদের মেধার বিকাশের সুযোগ পাবে, সমাজে সম্মানের সঙ্গে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে সমাজে, নিগৃহীত হবে না সমাজে সে নিজে এবং তার বাবা-মা তথাপরিবার, বাবা মায়ের মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূরীভূত হবে এ প্রত্যাশা করি।
সর্বোপরি সকল নাগরিকের মত সমান অধিকার পাবে তারাও। সদাশয় সরকারসহ সমাজের সর্বস্তরের জনগণ এ ব্যাপারে আরও এগিয়ে আসবেন, সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন একজন ভুক্তভোগী বিশেষ সন্তানের মা হিসাবে নতুন বছরে এটাই আমার প্রত্যাশা যাতে করে আমার সন্তানের মতো অন্য কোন শিশুকে মূলধারার স্কুল থেকে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বের করে না দেয় সে অন্যশিশুদের ক্ষতি করছে বলে। মানবতার জয় হোক।