দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বেশ রাত অব্দি ক্যান্টন টাওয়ারে কাটালাম আমরা। প্রায় তিন হাজার কোটি আরএমবি (রেনমিনবি) ব্যয়ে গড়ে তোলা টাওয়ারটি চীনের গুয়াংজুর অহংকারের প্রতীক। ২০০৫ সালে শুরু করে ২০১০ সালে উদ্বোধন করা হয়েছিল দেড় হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতার টাওয়ারটি। ওই বছরের এশিয়ান গেমস সামনে নিয়ে উদ্বোধন করা টাওয়ারটি তৎকালে বিশ্বের ফ্রিস্ট্যান্ডিং টাওয়ারের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। কানাডার সিএন টাওয়ারকে পেছনে ফেলে এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ টাওয়ারের স্থান দখল করেছিল। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের আগস্টে সাংহাই টাওয়ার নির্মাণের আগ পর্যন্ত এটি নিজের অবস্থান ধরে রেখেছিল। নদীর পাড়ে টাওয়ারটিকে দেখতে একেবারে সরু একটি কাঠির মতো মনে হলেও এটির ফ্লোর এরিয়া বিশাল। টাওয়ারটিতে ১২ লাখ ২৭ হাজার ৭০০ বর্গফুটের ফ্লোর এরিয়া রয়েছে। ছাদের আয়তন হচ্ছে ১৫১৬ বর্গফুট। ৯টি লিফট এবং এলিভেটর দিয়ে টাওয়ারটিতে হরদম লোক উঠানামা করছে। অবশ্য এজন্য মোটা অংকের ইয়েন খরচ করে টিকেট করতে হয়। দীর্ঘ লাইন সামাল দিয়ে তবেই ঘরের আকৃতির বিশাল লিফটের দেখা মিলে! লিফটে কোনরকমে ঠাঁই পেলে কেল্লাফতে। ১১২ তলার উচ্চতায় উঠতে খুব বেশি সময় লাগে না। দুনিয়ার অন্যতম সেরা দ্রুতগতির লিফটগুলোই ক্যান্টন টাওয়ারে লাগানো হয়েছে। অবজারভেশন টাওয়ার থেকে পুরো গুয়াংজু বাসররাতের ঘরণির মতো ঘোমটা উন্মুক্ত করে। মন ভরে যায়, হৃদয় গলে যায়, ক্যান্টন শহর এত সুন্দর! রাতের গুয়াংজু (ক্যান্টন) যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে!
ক্যান্টন টাওয়ারটি নদীর পাড়ে, একেবারে খোলা চত্বরে। আর পুরো চত্বর জুড়ে বিনোদনের নানা আয়োজন। রয়েছে স্ট্রিট ফুডের রমরমা বাজার। ক্যান্টন শহরের অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পটটিতে বিনোদনের অভাব রাখা হয়নি। কত কিছুই যে করা হচ্ছে! কেউ মনের সুখে গান গাচ্ছে, কেউবা বাজনা বাজাচ্ছে। আবার কেউ কেউ নানা ধরনের খাবার বিক্রি করছে। আর ক্ষণে ক্ষণে রূপ পাল্টানো অপরূপা ক্যান্টন টাওয়ার জুড়ে তো আলোর খেলা চলছেই! আমরা ঘুরে ঘুরে নানা কিছু দেখলাম, করলাম।
বেশ রাতে যখন বাসায় ফিরলাম তখন আমার ইউছুপ আলী ভাই ঘুমিয়ে গেছেন। এত রাত অবধি উনার জেগে থাকার কথাও নয়। ভাবীও ঘুম। জাহেদ ভাই দরোজা খুলে দিয়ে আবারো শুয়ে পড়লেন। শুয়ে পড়া ছাড়া আমাদেরও আর কোন কাজ ছিল না। খাওয়া দাওয়ার পাঠ আমরা চুকিয়ে ভাসমান জাহাজে। অতএব যত দ্রুত চোখ বন্ধ করা যায় ততই মঙ্গল। সকালে ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে। ইউছুপ আলী ভাই আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। একই সাথে নাস্তা করলাম। রাতের ক্রুজ এবং ক্যান্টন টাওয়ার দর্শনের বর্ণনা দিলাম। মায়ের কোলে বসে নানাবাড়ির গল্প বলার মতো। ইউছুপ আলী ভাই হাসলেন, বেশ মন দিয়ে শুনলেন আমার গালগপ্প। নিজে যে অসংখ্যবার এসব দেখেছেন, ঘুরেছেন, করেছেন তা জাহির করতে গেলেন না।
নাস্তা শেষে ইউছুপ আলী ভাই বললেন, ক্যান্টন ফেয়ার চলছে। দুনিয়ার অন্যতম বড় বাণিজ্য মেলা। গিয়ে দেখে আসুন। প্রচুর ভিড়, আমি অত হাঁটতে পারবো না। আমি বাসায় রেস্ট নিই, আপনি কায়সারের সাথে ঘুরে আসুন। ইউছুপ আলী ভাই কায়সার ভাইকে ডেকে সব নির্দেশনা দিয়ে দিলেন। ডেকে একটু আড়ালেও নিয়ে গেলেন। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, তিনি কিছু টাকা পয়সা কায়সার ভাইর হাতে তুলে দিলেন।
ইউছুপ আলী ভাই বললেন, তাড়াতাড়ি চলে যান। সকাল ৯টা থেকে মেলা শুরু হয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে লোকজন বেড়ে যায়। দীর্ঘ লাইনে পড়ে যাবেন। তাছাড়া আপনার রেজিস্ট্রেশন করতে হবে, আইডি কার্ড নিতে হবে। বেশ সময় লাগবে। বাণিজ্য মেলা দেখার কোন আগ্রহ আমার ছিল না। বিদেশে কোনদিনই কেনাকাটার প্রতি আমার কোন আগ্রহ থাকে না। তাছাড়া বাণিজ্য মেলায় কেনাকাটার চেয়ে প্রদর্শনই বেশি হয়। রপ্তানি বাণিজ্য চাঙ্গা করতে নেয়া হয় নানা আয়োজন। আমি যেহেতু ব্যবসায়ী নই এবং শেয়ার ব্যবসা ছাড়া দুনিয়ার আর কোন বাণিজ্যের সাথে জড়িতও নই তাই ক্যান্টন ফেয়ার আমাকে টানার কথা নয়। তবে দুনিয়ার অন্যতম বড় বাণিজ্য মেলা বলাতে কিছুটা উৎসাহী হয়ে উঠি। এত বড় মেলা যেহেতু হাতের কাছে তাহলে পা বাড়াতে সমস্যা কি!
আমরা গাড়ি নিলাম না। ইউছুপ আলী ভাইর বাসার কাছেই মেট্রো স্টেশন। পাতাল রেলে চড়ে মাত্র তিনটি স্টেশন পার হলেই ক্যান্টন ফেয়ার। এই মেলার কমপ্লেক্স এত বড় যে, মেলায় যাতায়াতের জন্য দুই দুইটি ট্রেন স্টেশন রয়েছে!
পাতাল রেলে প্রচুর ভিড়। কায়সার ভাই বললেন যে, সবাই ফেয়ারে যাচ্ছে। ওখানে গেলে দেখবেন পুরো ট্রেন ফাঁকা করে সব যাত্রী নেমে গেছে! আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মেলা যে ক্যান্টন ফেয়ারকে বলা হচ্ছে সেই ফেয়ারটি আসলে কত বড়! পাতাল রেল থেকে বের হওয়ার অল্পক্ষণ পরই আমরা ক্যান্টন ফেয়ার কমপ্লেক্সের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। নানামুখী তল্লাশির মধ্য দিয়ে আমাদেরকে মেলার দিকে যেতে হলো। শুরুতে রেজিস্ট্রেশন করাতে হলো। একশ’ আরএমবি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করানোর পর চমৎকার একটি আইডি কার্ড দেয়া হলো। এই আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে এগুলাম সামনের দিকে। যতই সামনে যাচ্ছিলাম বিস্ময়ের মাত্রা ততই বাড়ছিল। এত বড় কমপ্লেক্স! এত বড় আয়োজনে মেলা হয়!!
স্টিল স্ট্রাকচারের দারুণ একটি প্রদর্শনী কেন্দ্র। এটি স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র। এই কেন্দ্রটি শুধুমাত্র ক্যান্টন ফেয়ারের জন্যই বানানো হয়েছে। চীনের সবচেয়ে বনেদি এবং অভিজাত এই মেলাটি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় পণ্যমেলা সাংহাই এক্সপোর বহু আগ থেকে শুরু হয়েছিল। সাংহাই এঙপোর আগে এটিই ছিল চিনের সবচেয়ে বড় পণ্য মেলা। এখন অবশ্য এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা। ১৯৫৭ সালের বসন্ত থেকে এই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেই তখন থেকে প্রতিবছর বসন্ত এবং শরৎকালে মেলা পুরো গুয়াংজু কাঁপিয়ে দিয়ে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলার আগে এবং পরে বাস ট্রেনতো দূরের কথা, গুয়াংজুর জন্য বিমানের সিটও পাওয়া যায় না। পুরো দুনিয়া যেন গুয়াংজুতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
প্রত্যেক বছরকে দুইটি সেশনে ভাগ করে প্রতি সেশনে তিন বার করে মেলার আয়োজন করা হয়। অর্থাৎ বছরের শরৎ ও বসন্তকালে মোট ছয় বার ক্যান্টন ফেয়ারের আসর বসে। বসন্তকালীন অধিবেশনে ১৫ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল, ২৩ এপ্রিল থেকে ২৭ এপ্রিল এবং ১ মে থেকে ৫ মে পর্যন্ত মেলা চলে। শরৎকালীন অধিবেশনে ১৫ অক্টোবর থেকে ১৯ অক্টোবর, ২৩ অক্টোবর থেকে ২৭ অক্টোবর এবং ৩১ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত মেলা চলে। এই তারিখগুলো ফিঙড থাকে। প্রতিবছরই একই তারিখে মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
শুরুতে মেলার নাম ছিল ‘চীনা রপ্তানিকারক পণ্য মেলা’। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে নাম পাল্টে ‘চীন আমদানি ও রপ্তানি মেলা’ করা হয়েছে। চীনের বৈদেশিক বাণিজ্য কেন্দ্র দ্বারা পরিচালিত মেলাটি চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও গুয়াংজু প্রাদেশিক সরকার যৌথভাবে আয়োজন করে।
মেলায় ঢুকে আমার চোখ কপালে উঠতে শুরু করলো। এত বড় মেলা তো নয়ই, এত বড় আয়োজনও আমার জীবনে কোনদিন দেখিনি। এর আগে সবচেয়ে বড় পণ্য মেলা দেখেছিলাম জাপানের টোকিওতে। কিন্তু সেটিকেও এর কাছে নস্যি মনে হতে লাগলো। চারদিকে গিজগিজ করছে মানুষ, হাজার হাজার স্টলে থরে থরে সাজানো নানা পণ্য। বিশ্বের কারখানা খ্যাত চীনের ২৪ হাজারেরও বেশি কোম্পানি তাদের পণ্য প্রদর্শন করছে। এখানেও তিন ধাপে পণ্য প্রদর্শিত হয়। প্রথম ধাপে ইলেকট্রনিক্স ও গৃহস্থালী বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, আলোক সরঞ্জাম, যানবাহন ও খুচরা যন্ত্রাংশ, যন্ত্রপাতি, হার্ডওয়্যার ও যন্ত্রাংশ, জ্বালানি, রাসায়নিক পণ্য, নির্মাণ সামগ্রী প্রদর্শিত হয়। একই সাথে আমদানি পণ্যের জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্যাভিলিয়ন থাকে। দ্বিতীয় ধাপে ভোক্তা সামগ্রী, উপহার, গৃহসজ্জা এবং তৃতীয় ধাপে অফিস যোগান, বাঙ ও ব্যাগ, এবং বিনোদনমূলক পণ্য, মেডিকেল ডিভাইস এবং স্বাস্থ্য পণ্য, খাদ্য, জুতা, বস্ত্র ও গার্মেন্টস দ্রব্য প্রদর্শিত হয়। একই সাথে আন্তর্জাতিক প্যাভিলিয়নেও বিশ্বের নানা দেশের পণ্য স্থান পায়। বিশাল প্যাভিলিয়নের ১ কোটি ২১ লাখ ৭৪ হাজার বর্গফুট আয়তন জুড়ে নানা পণ্যের পসরা সাজে। সর্বনিম্ন ৬০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি বুথে এসব পণ্য প্রদর্শিত হয়। বর্তমানে গড়ে ৩০ হাজার মিলিয়নেরও বেশি ডলারের পণ্যের অর্ডার হয় ক্যান্টন ফেয়ারে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো যে, ক্যান্টন ফেয়ারে খুচরো কোন পণ্য বিক্রি হয়না। এখানে শুধু পণ্য প্রদর্শিত হয়, অর্ডার নেয়া হয়। সর্বনিম্ন অর্ডারেও যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি হয় তা শুনলে পিলে চমকে উঠে। গত আসরে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের পাশাপাশি বিশ্বের ২১৩টি দেশের মানুষ ক্যান্টন ফেয়ারে যোগ দিয়ে ৩০ হাজার ৫৭১ মিলিয়ন ডলারের পণ্যের অর্ডার করেছেন বলে তথ্য প্রদর্শিত হচ্ছিল। ক্যান্টন ফেয়ারের আকার বুঝাতে এর থেকে বেশি তথ্যের দরকার আছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। বুকের ভিতরে কেমন কেমন করার জন্যও আর বেশি কিছু লাগে না। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমাদের প্রমীলারা
পরবর্তী নিবন্ধকৃষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ ও করণীয়