দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ৪ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ভারতের অন্যতম সমৃদ্ধ এই শহরটির পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে ভালোলাগা। এত সুন্দর গোছানো একটি শহর! ভারতের কলকাতা, দিল্লী কিংবা মুম্বাইর বিপরীতে চণ্ডীগড় যেন অনন্য। ওই মেগাসিটিগুলোর মতো ব্যস্ততা হয়তো চণ্ডীগড়ে নেই, তবে অন্যরকমের এক স্নিগ্ধতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে রয়েছে। ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা একটি শহর। প্রচুর গাছগাছালী শহরের রাস্তা জুড়ে। বড় বড় ভবনের ঝুল বারান্দায়, বাড়ির আঙ্গিনায় ফুল গাছের সারি নজর কাড়ে। শপিং মলের সামনে ইউরোপ আমেরিকার মতো খোলা চত্বর। বিশাল পার্কিং। পার্কিং এরিয়া মানেই ইট পাথরের জঞ্জাল নয়, একই সাথে রয়েছে সারি সারি গাছও। আমি জানালার বাইরে চোখ দিয়ে সাত রাজ্যের মুগ্ধতা নিয়ে শহর দেখছিলাম। সবগুলো রাস্তাই যত দূর চোখ যায় সোজা। মাইলের পর মাইলে কোন বাঁক নেই। কিছুদূর পর পর চৌমুহনী। সৃষ্টি করেছে নতুন রাস্তা। ওই রাস্তার দিকে তাকালেও একই ধরনের সোজা। পুরো শহরটিই যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সব বর্গক্ষেত্রের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। ছুটছিল আমাদের ট্রাভেলার্স। এখন বেশ গতি নিয়ে এগুচ্ছে আমাদের গাড়ি।
হোটেল তাজ চণ্ডীগড়-এ আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের ট্যুর অপারেটর অথেনটিক ট্যুরিজমের কর্ণধার লায়ন আনোয়ারুল আজিম সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন। এতে করে অচিন শহরেও আমাদের বাড়তি কোন ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি, হয়না। শহরের সেরা সেরা হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। চণ্ডীগড়েও তার ব্যতিক্রম হবে না। অতএব হোটেল কেমন হবে তা নিয়ে কোন ধরনের দুঃচিন্তা করতে হয় না। সকালের ব্রেকফাস্ট হোটেলেই থাকে। নাস্তা নিয়েও চিন্তা করতে হয় না। ঘোরার সময় যেখানে সময় হয় সেখানেই লাঞ্চ ডিনার সারিয়ে নেয়া যায়, নাহলে হোটেলেও খাবারের ব্যবস্থা থাকে। এতে করে অচিনপুরীতে থাকা খাওয়া নিয়ে ভুগতে হয় না আমাদের। চিন্তাও থাকে না। তাই রিল্যাঙে শহর দেখে পার করছিলাম সময়। চণ্ডীগড়ে হয়তো আর কোনদিনই আসা হবে না।
দুপুর গড়িয়েছে বেশ আগে। বিকেল ছুঁই ছুঁই করছে। আমার এডিটর স্যার দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক লাঞ্চ করেই হোটেলে যাওয়ার প্রস্তাব করলেন। বিষয়টি লুফে নিলেন কনফিডেন্স সিমেন্টের অন্যতম কর্ণধার লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া। আমরা সকলেই সায় দিলাম। বেলা গড়াতে শুরু করেছে। পেটে জানান দিচ্ছে ক্ষুধা। লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া হিন্দিতে বিষয়টি ট্রাভেলার্সের চালককে বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, একটি ভালো রেস্টুরেন্টে যান। লাঞ্চ সেরেই আমরা হোটেলে ফিরবো। চালক মাথা নাড়লেন।
বিশাল এক শপিং মলে সামনে এসে দাঁড় করানো হলো আমাদের গাড়ি। একটি চক্কর দিয়ে পার্কিংও পাওয়া গেল। চালক আমাদের নামার ইশারা করে বললেন, এটি চণ্ডীগড়ের সবচেয়ে ভালো শপিং এরিয়া। পাশেই সব রেস্টুরেন্ট। ইচ্ছে করলে শপিংও করতে পারবেন। কি কি সব বিখ্যাত শাড়ি টাড়ির নামও ড্রাইভার বললেন। শাড়ি টাড়ি কেনার ব্যাপারে আমাদের কারো কারো কিছুটা আগ্রহ থাকলেও শুরুতে রেস্টুরেন্টের দিকে যাত্রা করলাম আমরা। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে লায়ন নিশাত ইমরান, লায়ন গুলশান আকতার চৌধুরী রেহেনা এবং আমার স্ত্রী শামীমা নার্গিস পাশের শপিং মলে চলে গেলেন। উনারা যাওয়ার সময় আমার ম্যাডাম লায়ন কামরুন মালেকও জোর করে সাথে নিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম যে, ড্রাইভারের শাড়ি কাহিনী আমাদের কারো কারো মাথায় বেশ ভালোভাবে ঢুকেছে। এতে করে শাড়ি টাড়ি কেনাকাটা না করে ওনারা গাড়িতে উঠবেন না। আমরা কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলাম। অতপর নিজেরাও শপিং মলে ঢুকে পড়লাম। আমার এডিটর স্যার, লায়ন রূপম কিশোর বড়ুয়া কিংবা আমার কোন কেনাকাটা নেই। কোন কিছুর তাড়াও নেই। তাই আয়েশি ভাব নিয়ে দোকান থেকে দোকানে চক্কর দিতে লাগলাম।
সন্ধ্যা নামার আগ দিয়ে আমাদের নিয়ে আবারো যাত্রা করলো ট্রাভেলার্স।
চমৎকার একটি রাস্তা ধরে এগুচ্ছিলাম আমরা। রাস্তার দুইপাশে প্রচুর বড় বড় গাছ। পুরো রাস্তাটিতে কেমন যেন মায়া ছড়িয়ে রেখেছে। সন্ধ্যার আগ দিয়ে কেমন জঙ্গলের মতো লাগছিল রাস্তাটিকে। কয়েকদিন পাহাড়ে জঙ্গলে থাকতে থাকতে সবকিছুই জঙ্গলের মতো লাগছে কিনা কে জানে! বড়সড় কয়েকটি গাছের ফাঁক দিয়ে ডানে টার্ণ নিতেই চোখের সামনে ঝলমলিয়ে উঠলো হোটেল তাজ চণ্ডীগড়। বিশাল হোটেল। গেটও বড়। গেটের দারোয়ানও বেশ তাগড়া। তারা আমাদের গাড়ির বাইরে নানাভাবে চেক করলো। মুম্বাইর হোটেল তাজ-এ সন্ত্রাসী হামলার পর এই গ্রুপের সব হোটেলই ব্যাপক কড়াকড়ি চালু করেছে। অবশ্য গত ক’ বছরে দুনিয়ার সব হোটেলই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অনেক বেশি জোরদার করেছে। চেকিং শেষে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল গেট। আমাদের গাড়ি ভিতরে প্রবেশ করলো। গাড়ি বারান্দায় থামার সাথে সাথে ছুটে এলো কয়েকজন বেল বয়। যাত্রাপালার সেনাপতির মতো বাঁকা তলোয়ার ঝুলিয়েও এলো একজন। বাহারী গোঁফে দারুণ মানিয়েছে তাকে। মাথার পাগড়িও বেশ চটকদার। বুকের উপর জোড় হাত করে এমনভাবে বাঁকা হয়ে তিনি অভিবাদন জানালেন যে, আমি মনে মনে হেসে উঠলাম। আমার নিজেকে বেশ রাজা রাজা লাগছিল। বডি স্কেনারের ভিতর দিয়ে হোটেলের লবিতে প্রবেশ করলাম আমরা।
রিসিপশনের মেয়েগুলো দারুণ অভ্যর্থনা জানালো আমাদের। এক তরুণী ওয়েলকাম ড্রিংকস সার্ভ করলো। পুদিনার শরবত। সাথে আর কি আছে কে জানে! স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় লাগছিল। রিসিপশনে সকলের পাসপোর্ট জমা দিলাম। আমাদের রুমের চাবি দিয়ে দেয়া হলো। রুমের দরোজা খুলেই আমার চোখ নেচে উঠলো। এত সুন্দর রুম! এত গোছানো!! শুধু বিছানাই নয়, চমৎকার সব আসবাব রুমজুড়ে। একপাশে বিশাল এক সেক্রেটারিয়েট টেবিল, রিভলভিং চেয়ার। টেবিলের উপর চমৎকার একটি টেবিল ল্যাম্প। সবুজের উপর কাজ করা চমৎকার একটি প্যাড এবং দারুণ একটি কলম সাজিয়ে রাখা হয়েছে টেবিলে। রাখা হয়েছে একটি ইংরেজী পত্রিকাও। সবকিছু মিলে রুমটি শুধু ঘুমানোরই নয়, স্বপ্ন বুননের জায়গা বলেও আমার মনে হলো।
ফ্রেশ হলাম। কফি মেকারে ফুটছিল পানি। আমি ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার আগেই ঘরণী ইলেক্ট্রিক কেটলিতে পানি ফুটাতে শুরু করেছে। ধুমায়িত কফি নিয়ে চেয়ারে বসলাম। বাহ, চেয়ার এবং টেবিলের গুণে কফিও বুঝি অনন্য হয়ে উঠলো।
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ হলো। কিন্তু রুমের ভিতরে তা বুঝা যাচ্ছিল না। একপাশের দেয়ালের পুরোটাই কাঁচ। ভারি পর্দা। আমি সরিয়ে দিলাম। চন্ডীগড়ের সন্ধ্যা বেশ মোহনীয়ভাবে ধরা দিল। সত্যিই, দারুণ এক রঙ খেলা করছিল। আকাশ জুড়ে রঙের মেলা! আমি রয়ে সয়ে কফি খাচ্ছিলাম। আমরা প্রত্যেকেই রুমে রুমে। দিনভর জার্নির ক্লান্তিতে কাহিল শরীর। তবুও মন কেমন যেন আনচান করছিল।
ইন্টারকমে এডিটর স্যারের সাথে কথা বললাম। বের হবেন কিনা জানতে চাইলাম। কাছেই একটি রোজ গার্ডেন আছে বলে জানালাম। দেখতে যাবেন কিনা জানতে চাইলাম। কিন্তু এডিটর স্যার এবং ম্যাডাম বের হবেন না বলে জানালেন। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করলাম। গুগল ম্যাপ দেখাচ্ছে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই রোজ গার্ডেন, গোলাপের বাগান। এত সুন্দর একটি শহরের গোলাপ বাগান নিশ্চয় সুন্দর হবে। ঘরনীকে মোলায়েম করে বললাম, ‘চলো গোলাপ দেখে আসি।’ আমার কোন কিছুতেই কখনো না করে না গিন্নী। অতএব অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গুগল ম্যাপে ডিরেকশন দেখে হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু তাজ চণ্ডীগড় থেকে বের হয়ে একটু সামনে এগুতেই গা ছমছম করে উঠলো। ঘন জঙ্গলের মতো রাস্তা। গাছগাছালী এত বেশি যে স্ট্রিট লাইটের আলোও অন্ধকার পুরোপুরি দূর করতে পারছিল না। কেমন এক আলো আঁধারী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। গা ছমছম আবহ। গুগল ম্যাপ ধরে এগুচ্ছিলাম। কিন্তু পাঁচতারকা একটি হোটেলের পাশের রাস্তা এমন জঙ্গল! এখনি জঙ্গল থেকে বের হয়ে পথ আগলে দাঁড়াবে নাতো! আমি পাসপোর্ট দুইটি যত্ন করে লুকিয়ে ফেললাম। কিছু টাকা কড়ি পকেটে রেখে বাকিগুলোও লুকালাম। কিছু ঘরনীর হাতে দিলাম। বেচারী মাস্টারি করে জীবন কাটায়। সাধাসিধে মানুষ, কিছুটা বাড়তি নিরীহ। আমার টাকা কড়ি লুকানোর ধরণ দেখে সে ভয় পেয়ে গেল। বললো, ‘চলো, রুমে চলে যাই। কি দরকার এত রিস্ক নেয়া।’ আমি তার হাতটি হাতের মুঠোয় নিলাম। আশ্বস্ত করলাম। বললাম, ‘আমরা বিদেশি পর্যটক। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই। কিছুটা বাড়তি কদরতো পাবোই।’ হাঁটছিলাম আমরা। পুরো পথটিতে আমরা ছাড়া আর কোন পথচারী নেই। দু’চারটি গাড়ি মাঝে মধ্যে ছুটে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা অনেক বড় একটি রাস্তায় উঠে এলাম। শত শত গাড়ি ছুটছে। খেয়াল করে দেখলাম যে, আমার ঘরনীর ফ্যাকাশে মুখে আলো খেলা করতে শুরু করেছে। (চলবে)।
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাইন্ড রিডার
পরবর্তী নিবন্ধআখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু : একটি আদর্শের নাম