দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১১ মে, ২০২২ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আমাদের গাড়ির গতি কমে আসলো। বামে ইন্ডিকেটর দিয়ে পরিবর্তন করা হলো লেইন। বুঝতে পারছিলাম যে গাড়ি থামানো হবে। গাছ থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে কমলা খাওয়ার জন্য মহাসড়কের লাগোয়া একটি বাগানের পাশে থামানো হচ্ছে গাড়ি। মহাসড়কের দুই ধারে অসংখ্য বাগান। যে কোন একটিতে থেমে গেলেই কমলা খাওয়া যাবে। গাড়ি থেকে যতটুক দেখা যাচ্ছে শুধু বাগান আর বাগান। প্রতিটি বাগানেই ঝুলছে থোকায় থোকায় কমলা। সবুজ গাছগুলোতে কমলারঙের ফল গুলো অনন্য সুন্দর লাগছিল। যেন নীলাম্বরীতে ঢাকা এক একটি চাঁদমুখ।

মহাসড়কের পাশে যে কোন একটি বাগানে ঢুকে পড়লেই কমলা খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে আমাদের চালক এই বাগানটিতে কেন গাড়ি দাঁড় করালেন তা একটু পরই বুঝুত পারলাম আমি। শুরুতে মনে হয়েছিল কমিশন বাণিজ্য। কারণ বিদেশে যত ড্রাইভারই আপনি পাবেন তাদের সবগুলোর সাথে কোন না কোন দোকানের, বাগানের, শোরুমের কন্ট্রাক্ট থাকে। প্রতিজন যাত্রীর মাথা চড়া সস্তা দুভাবেই বিক্রি হয়। কোথাও কেবল খাবারের বিনিময়ে, কোথাও নগদ কড়ি, আবার কোথাও মোট বিক্রির উপর কমিশন। এরা আপনাকে ঘুরিয়ে পেছিয়ে পোটলা বানিয়ে নির্দিষ্টস্থানেই নিয়ে গিয়ে কসাইর হাওলা করে দেবে। তারা আচ্ছামতো আপনাকে জবাই করবে। কখনো ধারালো ছুরি বা কখনো একেবারে ভোঁতা ছুরি দিয়ে জবাই হতে হবে আপনাকে।

যাক, আমাদের চীনা ড্রাইভার গাড়ি থামালেন। গাড়ি থেকে নামার পর বুঝতে পারলাম যে, না আমাদের এই যাত্রায় কোন কমিশন নেই। আমাদের জবাই হওয়ার শংকা নেই। আসলে কমলাবাগানের কাছে মহাসড়কের উপর বিশাল একটি গাছ। রাস্তার পাশে অনেকটা অযতনে বেড়ে উঠা বড়সড় গাছটি দারুণ এক ছায়া সুশীতল পরিবেশ তৈরি করেছে। অচিন একটি গাছ। ছোট ছোট পাতায় দারুণ সবুজ চাদরে যে পুরো আকাশ মোলায়েম করে ঢেকে রাখা হয়েছে। নিচে রাস্তায় তৈরি হয়েছে চমৎকার এক সুশীতল পরিবেশ, আবহ। যে ছায়ায় গাড়ি রাখলে সেটি যেমন আরামে থাকবে, তেমনি পরে চড়তে আমরাও আরাম পাবো। গরমে বা সূর্যের আলোতে গাড়িটি ‘গরম’ হয়ে যাবে না। আমি মনে মনে চীনা ড্রাইভারের চীনা বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না।

কমলা বাগানের গেটটি অতি সাধারণ। শক্তপোক্ত নয়, একেবারে ঠুনকো একটি বেড়া। লক্কর ঝক্কর টাইপের গেটটি ঠেলা দিতেই খুলে গেল। আমরা বিশাল বাগানটিতে প্রবেশ করলাম। দারুন একটি বাগান। যেনো সবুজ চাদরে ঢাকা। প্রতিটি গাছেই থরে থরে ঝুলছে কমলা। নানা সাইজের কমলা। কোনটি বেশ বড়, কোনটি একটু ছোট, আবার কোন কোনটি একটু যেনো অন্যরকম। রঙের বাহারও দারুণ। কোন কোনটি একেবারে কমলা রঙের। হলদে। আবার কোনটিতে একটু আধটু সবুজাভ ছাপ রয়েছে। কোন কোনটি একেবারে সবুজ, কাঁচা। বাগানটি বড় হলেও পাহারা টাহারার কোন ব্যবস্থা নজরে এলো না। কোন টঙ ঘর বা রাতে থাকার মতো কোন ঝুপড়ি বাগানটিতে নেই। এটি কী রাতভর অরক্ষিত থাকে! অবশ্য আমাদের দেশের টমেটো ক্ষেতের মতো চারদিকে ঘেরা দেয়া। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখানে চোর চ্যাচ্ছড় নেই। ক্ষেতের ফসল চুরি করার মতো কোন চোর নেই, অথবা চুরি করে লাভ নেই। কথাটি বলতে আমাদের গাইড বললেন যে, তাইজুতে প্রচুর কমলা হয়। প্রায় সবার বাগানেই কমলা রয়েছে। বাগানের পাশাপাশি ঘরদোরেও কমলা গাছ লাগানো রয়েছে। সেখানেও ঝুলছে কমলা। যাদের একেবারে কিছু নেই তাদের বাড়িতে হলেও দু’চারটি কমলা গাছ রয়েছে। যেখানে কমলা ঝুলছে। একেবারে নিম্নবিত্ত যেসব মানুষ আছে যাদের বাগান বা গাছ নেই তারাও প্রতিবেশির কাছে হরদম কিছু কমলা পেয়ে থাকে। সুতরাং চুরি করে লাভ কী হবে! আর লাভ নেই বলেই গাছে গাছে পাকা পাকা কমলা অবলীলায় ঝুলে আছে!

বাগানের ভিতরে কাজ করছিলেন বেশ বয়স্ক একজন চাষী, কমলা ক্ষেতের শ্রমিক। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই কৃষক শ্রমিকদের চেহারা প্রায় একই রকম। কিছুটা পরিশ্রান্ত, কিছুটা হাড় জিরজিরে। বয়স্ক এই মানুষটি এই ক্ষেতের মালিক নাকি শ্রমিক তা বুঝতে পারছিলাম না। তিনি কমলা ছিঁড়ে একটি ঢালিতে ভরছিলেন। বড়সড় ঢালি। আমাদের গাইড তার সাথে গিয়ে কি কি সব কথা বললেন, চীনা ভাষায়। অতপর গাইড লায়ন ফজলে করিমকে কি কি সব বললেন। লায়ন ফজলে করিম আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন, যত ইচ্ছে কমলা ছিঁড়তে পারেন। যে কোন গাছ থেকে যে কোন ফল। তবে খাওয়ার আগে অবশ্যই পরিমাপ করিয়ে নিতে হবে। এটিতে ভুল করবেন না। অর্থাৎ আমরা যে পরিমাণ কমলা ছিঁড়বো ঠিক সেই পরিমানের দামই পরিশোধ করতে হবে। গাছ থেকে ছিঁড়ে খাওয়া যাবে, তবে খাওয়ার আগে ওজন করিয়ে নিতে হবে। অবশ্য বিশ্বের নানা দেশে বাগানে নির্দিষ্ট পরিমানের অর্থ পরিশোধ করে যত ইচ্ছে ফল খাওয়ার নিয়ম চালু রয়েছে। চীনেও এই ধরনের নিয়ম অবশ্যই কোথাও না কোথাও চালু থাকবে। ব্যুফে। নির্দিষ্ট পরিমানে অর্থ দিয়ে যত ইচ্ছে ফল খাওয়া। কিন্তু এই বাগানটিতে ওই সুবিধা না দিয়ে খাওয়ার আগে পরিমাপের শর্ত দেয়া হয়েছে। আমার মনে হলো, বুড়ো মানুষটি কোন রিস্ক নিতে চাচ্ছেন না। খেয়ে যদি টাকা না দিই! আবার দলে আমরা দুই তিনজন বেশ মোটা সাইজের মানুষ। পেটও বিশাল। অবাধে খেতে দিলে যদি বেশি খেয়ে ফেলি!

বুড়োর শর্তে রাজি হয়ে যাই আমরা। অবশ্য কমলা খাওয়ার চেয়ে ছবি তোলার প্রতি বেশি আগ্রহ আমাদের। তাই গাছ থেকে কমলা ছেঁড়ার আগে আমরা ছবি তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়ি। শত শত কমলা ঝুলছে, প্রতিটি গাছেই অগুনতি পাকা কমলা। বাগানটি বিশাল, কত গাছ আছে কে জানে! এই ধরণের একটি বাগান থেকে কী পরিমাণ কমলা পাওয়া যায় সেই সম্পর্কেও আমাদের কারোরই কোন ধারণা নেই। বুড়োর সাক্ষাৎকার নেয়ারও সুযোগ নেই। মেন্ডারিন ভাষী চাষীর একটি শব্দও বুঝার শক্তি নেই আমার। গাইডের সহায়তায় হয়তো আলাপ করা যেতো, কিন্তু বুড়ো চাষী শুরু থেকে আমাদের প্রতি এত উদাসীন যে আলাপ জমবে বলে মনে হলো না। উনি নিজের মনে গাছের যত্ন নিচ্ছেন। ঘাস নিড়াচ্ছেন। ফল ছিঁড়ছেন। আমরা কী করছি তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথাও দেখা গেল না।
বাগানজুড়ে থোকায় থোকায় কমলা। সবই হাতের নাগালে। কোন কোনটি একটু উঁচুতে। তবে ঢাল ধরে টান দিলে হাতে চলে আসছে। সবুজ গাছে কমলা রঙের ফলগুলো কী যে সুন্দর লাগছিল! সূর্যের আলোতে চিকচিক করছিল টাটকা ফলগুলো। আমরা মন ভরে কমলা ছিঁড়লাম। যেটি ভালো লাগছিল সেটিই ছিঁড়ছিলাম, যেটি ইচ্ছে করছিল সেটিতেই হাত ছোঁয়াচ্ছিলাম। হাতে পকেটে ঢালিতে শুধু কমলা আর কমলা। হৈ চৈ করতে করতে এত বেশি কমলা আমরা ছিঁড়ে ফেললাম যে দু’চারদিনেও তা খেয়ে শেষ করা সম্ভব হবে না। ছিঁড়তে ভালো লাগছিল বলে আমরা লুটের মালের মতো হরিলুট চালাচ্ছিলাম। ভদ্রভাবে বলতে গেলে আমরা ছেঁড়াছেঁড়ির উৎসবে মেতে উঠেছিলাম!

চাষী ভাই আমাদের ছেঁড়াছেঁড়িতে কোন বাধা দিলেন না। তিনি নিজের মতো করে কাজ করছিলেন। গেটের কাছে একটি টেবিল, তার উপর একটি ডিজিটাল বাটখারা। পাশে বেতের তৈরি একটি ঢালিও রয়েছে। আমরা সকলে এসে আমাদের হাতে এবং পকেটে থাকা কমলাগুলো একে একে ঢালিতে রাখলাম। ঢালি উপচে পড়ার উপক্রম। ওজন করা হলো। ওজনের পরই আমরা ঢালির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। ক্ষেতে বসে ক্ষেত থেকে তোলা কমলার বাগল ছিলতে লাগলাম, কমলা ভাঙতে লাগলাম। আমরা কোনটি পুরো খেলাম, কোনটির অর্ধেক খেয়ে অন্যজনের দিকে ছুঁড়ে মারলাম। কোন কোষ পুরোটাই খেলাম, আবার কোনটি একটু চুষে ফেলে দিলাম। রসে টইটুম্বর এক একটি কোষ আমাদের শরীর মন চাঙ্গা করে তুলছিল। আমরা ঠিক কতক্ষণ ধরে কতগুলো কমলা খেলাম তা খেয়াল নেই। শুধু এটুকু খেয়াল আছে যে, আমরা বহুক্ষণ ধরে নিজেদের মতো করে উৎসব করতে করতে আস্ত বাগানটিকে যেন মাথায় তুলে রেখেছিলাম। (চলবে)

লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসম্ভবের সাথে লড়াই : ওসমান গনি মনসুরের করুণ সাহিত্য-সৌধ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ