জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্ম্দ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১২ আগস্ট, ২০২২ at ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একটি আদর্শ জীবন
পৃথিবীর ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম ইমাম হোসাইন। আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে অনন্য অসাধারণ দৃষ্টান্ত ইমাম হোসাইন। যুগে যুগে দ্বীনের ঝান্ডা সমুন্নত রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে বাতিল অপশক্তির ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে ঈমানী চেতনার উৎস ইমাম হোসাইন। মানব জীবনের সর্বস্তরে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়নের কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ একটি পবিত্র সত্ত্বার নাম ইমাম হোসাইন।
ধরাধামে শুভাগমন: প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র মওলা আলী শেরে খোদা (রা.)’র আদরের দুলাল, মা ফাতেমাতুজ্জোহরা (রা.)’র নয়নমনি কলিজার টুকরা, বেহেস্তের যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ৪ হিজরীর ৫ শাবান মঙ্গলবার মদীনা মুনাওয়ারা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর হযরত আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিব (রা.)’র স্ত্রী হযরত উম্মুল ফযল বিনতে হারেছ (রা.) তাঁকে দুগ্ধ পান করান। হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য স্বীয় মুখে চিবিয়ে নরম করে এ নূরানী শিশু সন্তানের মুখে তুলে দেন। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নবজাতকের ডান কানে আযান এবং বাম কানে তাকবীর দিলেন। তাঁর মুখে নবীজির লালা মুবারক প্রবেশ করালেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করলেন। সপ্তম দিনে নাম রাখলেন “হোসাইন” এবং তাঁর পক্ষ থেকে একটি বকরী দ্বারা আকীকা করলেন। অত:পর হযরত ফাতেমা (রা.) কে বলেছিলেন, হোসাইনের মাথা মুড়িয়ে দাও এবং তার চুলের সমপরিমাণ ওযনের রৌপ্য সাদকা করে দাও। (তাশরীফুল বশর, পৃ: ২৮)
নাম মুবারক ও উপনাম: নাম-হোসাইন, উপনাম-আবু আবদুল্লাহ, উপাধি সৈয়্যদুশ শোহাদা, সিবতে রাসূল (রাসূলের দৌহিত্র)।
নামকরণে জিবরাঈল (আ.)’র সংবাদ: প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট যখন এ নবজাতকের জন্মের শুভ সংবাদ পৌঁছল। তিনি শাহজাদী সৈয়্যদা ফাতেমাতুজ জাহরা খাতুনে জান্নাত এর ঘরে তাশরীফ নিলেন। হযরত আলী (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলেন কি নাম রেখেছো? তিনি আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ ব্যাপারে আমার কি সুযোগ যে, আমি হুযুরের অগ্রগামী হবো? হুযুর আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, হে আলী! তাঁর নামকরণের ব্যাপারে আমি ওহীর অপেক্ষায় আছি। ইতিমধ্যে হযরত জিবরাঈল (আ.) হুযুরের খেদমতে হাজির হয়ে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! হযরত হারূন (আ.) এর তিন পুত্রের নাম ইবরানী ভাষায় যথাক্রমে শিব্বির, শাব্বির ও মুশাব্বির ছিল। যার আরবী অনুবাদ হাসান, হোসাইন ও মুহসিন। বড় শাহজাদার নাম যেহেতু হাসান, সুতরাং এর নাম হোসাইন রাখুন। অত:পর হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নাম হোসাইন রাখলেন। (মাসালিকুস সালেক্বীন, ১:১৯৫ ও খযীনাতুল আসফিয়া ১:৩৮)
হযরত হাসান ও হোসাইন (রা.) এর নামকরণ প্রসঙ্গে একাধিক হাদীস বর্ণিত আছে। এরশাদ হয়েছে, “হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, যখন হাসান জন্মগ্রহণ করেন তিনি তাঁর নাম রাখলেন, হামযা এবং যখন হযরত হোসাইন জন্মগ্রহণ করেন তাঁর নাম স্বীয় চাচার নামানুসারে জাফর রাখলেন। হযরত আলী (রা.) বলেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে বললেন, এ দু’জনের নাম পরিবর্তন করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি। (হযরত আলী বলেন) আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত। অত:পর হুযুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের নাম রাখেন হাসান ও হোসাইন। (গায়াতুল ইযাব ফী মানাক্বিবিস সাহাবা ওয়াল ক্বারাবাহ, পৃ: ১৮১)
শিক্ষা-দীক্ষা: হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) দরবারে রেসালতের নূরানী পাঠশালার অনন্য অসাধারণ প্রতিভাধর শিক্ষার্থী ছিলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সার্বিক তত্ত্বাবধানে জ্ঞান প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্যে গভীর ব্যুৎপত্তি ও পূর্ণতা অর্জন করেন। নবীজি তাঁকে সর্বাধিক আদর স্নেহ করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনম্র, খোদাভীরু, দয়া ও করুণা প্রদর্শনে প্রিয় রাসূলের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। দুরন্ত দুর্বার প্রচন্ড সাহসী, অকুতোভয়, তেজস্বী ও অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে আপোষহীন নির্ভীক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। স্বয়ং রাসূলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও জানতেন যে, এমন এক যুগ আসবে যে, এই প্রিয় দৌহিত্রই আমার উম্মতকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করবে। আমার প্রচারিত দ্বীনের ঝান্ডা সমুন্নত করবে। নিজের পরিবার-পরিজনসহ জীবনের বিনিময়ে ইসলামের মর্যাদা ও আদর্শকে অক্ষুন্ন রাখবে।
উত্তম চরিত্র: তাজেদারে কারবালা হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ছিলেন, উত্তম চরিত্রের এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, পারস্পরিক সহমর্মিতা, হৃদ্যতা তাঁর চরিত্রের মহৎ গুণ। অসহায়, অনাথ, দুর্বল, নিঃস্ব, গরীব, ফকীর ও মিসকিনদের প্রতি তিনি ছিলেন উদার সহনশীল, দানশীল ও আশ্রয়দাতা। নম্র স্বভাব ও উত্তম সহজ সরল আদর্শ চরিত্র ছিল তাঁর সহজাত বৈশিষ্ট্য। তাঁর জীবনের অসংখ্য ঘটনাবলী এর উজ্বল প্রমাণ বহন করে।
এক্ষেত্রে একটি ঘটনার উল্লেখ প্রযোজ্য: একদিন তিনি কতিপয় মেহমানের সাথে খাবার গ্রহণ করছিলেন। ক্রীতাদাস প্রচন্ড গরম ঝোলের পাত্র দস্তরখানায় পরিবেশনের সময় ভীত কম্পিত হয়ে ঝোলের পাত্র হাত থেকে নীচে পড়ে গেল। ঝোল ছিটকে তাঁর চেহারা মুবারকে গিয়ে পড়ল। তিনি পরিবেশনকারীর দিকে দৃষ্টিপাত করা মাত্রই লোকটি নিতান্ত আদব ও বিনয়ের সাথে আরজ করল (রাগ সংবরণকারী)। তিনি বললেন, (আমি রাগ সংবরণ করলাম) ক্রীতদাস লোকটি আবার বলল, (মানুষকে ক্ষমাকারী)। তিনি জবাব দিলেন, (আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম)। লোকটি পুনরায় বলল, (কল্যাণকামীদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন)। তিনি উত্তর দিলেন, (আমি তোমাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে আযাদ করে দিলাম)।
হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র মর্যাদার বর্ণনা: হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র মর্যাদার বর্ণনায় অসংখ্য হাদীস শরীফ বর্ণিত আছে। প্রথমে সেসব হাদীস উল্লেখ করা হল যেগুলো হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র সুমহান মর্যাদা ও প্রশংসায় বর্ণিত হয়েছে। এতদসঙ্গে উভয় শাহজাদা হাসনাইনে করীমাইন (রা.)’র ফযীলতের বর্ণনা সম্বলিত কয়েকটি হাদীস পেশ করা হলো।
তিরমিযী শরীফের হাদীস হযরত ইয়ালা বিন মুররাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, হুযুর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হোসাইন আমার থেকে আমি হোসাইন থেকে। হোসাইন (রা.)’র সাথে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে হোসাইনের নিবিড় ঘনিষ্টতা যেন উভয়ে অভিন্ন সত্ত্বা। হোসাইনের স্মরণ করা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্মরণ করা, হোসাইনকে ভালবাসা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালবাসা, হোসাইনের প্রতি বিদ্বেষ রাখা হুযুরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা, হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র সাথে যুদ্ধ করা মানে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাথে যুদ্ধ করার শামিল।
হযরত আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) বায়তুল্লাহ শরীফের ছায়াতলে দন্ডায়মান ছিলেন। তিনি হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)কে এদিকে তাশরীফ আনতে দেখে বলে উঠলেন, আজকে আসমানবাসীদের নিকট যমীনবাসীদের থেকে ইনিই সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। (আশ-শরফুল মুয়াব্বদ, পৃ: ৬৫)
হযরত আল্লামা জামী (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন সরকারে দো’আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) কে নিজের ডানদিকে এবং সাহেবজাদা হযরত ইবরাহীম (রা.) কে নিজের বামদিকে বসালেন। এমতাবস্থায় হযরত জিবরাঈল (আ.) উপস্থিত হলেন। আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তায়ালা এ দু’জনকে একত্রে আপনার নিকট রাখবেন না। দু’জনের একজনকে ওফাত দান করবেন। দু’জনের যে কোন একজনকে আপনি নির্বাচন করুন। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যদি হোসাইনের ওফাত হয় তবে তাঁর বিরহে ফাতেমা ও আলী ভীষণ কষ্ট পাবে, আমিও কষ্ট পাব। আর যদি ইবরাহীমের ওফাত হয় তবে আমি অধিক কষ্ট পাব। আমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব। এ ঘটনার তিনদিন পর হযরত ইবরাহীম (রা.) ওফাতবরণ করেন। যখনই হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র খেদমতে আসতেন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারহাবা বলতেন, কপালে চুম্বন করতেন এবং উপস্থিত লোকজনকে বলতেন, আমি হোসাইনের ওপর আমার পুত্র ইবরাহীমকে কুরবান করেছি। (শাওয়াহেদুন নবুওয়াত, পৃ: ৩০৫)। আল্লাহ তা’আলা হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র আদর্শ আমাদের নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ রেজাউল করিম
আমান বাজার, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু কে গালমন্দকারী শিয়াদের কে মুসলমান বলা যাবে কিনা?
উত্তর: আলহামদুলিল্লাহ ইসলামী শরীয়তে সাহাবায়ে কেরামে মর্যাদা ও সম্মানের আলোচনা পবিত্র কুরআন ও হাদীসে রাসূল দ্বারা প্রমানিত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, কোনো মুসলমানকে গালমন্দ করা ফাসেকী। (বুখারী শরীফ, ২য় খন্ড)
সাহাবায়ে কেরামকে গালমন্দ বড় ধরনের গুনাহ বিশেষত: হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও হযরত ওমর (রা.) কে গালমন্দ করা কুফরী। অন্য সাহাবাদের সমালোচনা করা ও গালমন্দ করা হারাম। প্রসিদ্ধ ফাতয়া গ্রন্থ দূররুল মুখতার কিতাবে উল্লেখ আছে, যারা হযরত আবু বকর (রা.) ও হযরত ওমর (রা.) কে গালমন্দ করল ও সমালোচনা করণ তারা কুফরী করল। তাদের তাওবা কবুল হবে না। (দুররুল মুখতার, খন্ড: ৩, পৃ: ৩২০)। পথভ্রষ্ট শিয়া সম্প্রদায় হযরত সিদ্দিক আকবর (রা.) ও হযরত উমর (রা.)’র খিলাফত অস্বীকারকারী। শিয়ারা আজানেও বিকৃত করেছে তাদের আজানে শব্দ সংযোজন করেছে নিম্নরূপ : “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ আলীউন খলিফাতুল্লাহ”। শিয়ারা উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)’র প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে পবিত্র কুরআনের বিরোধিতা করেছে। ফাতওয়া আলমগীরে উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি হযরত আয়েশা (রা.) বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে সে আল্লাহর সাথে কুফরী করেছে, আরো উল্লেখ করা হয়েছে, যে ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র ইমামত অস্বীকার করেছে সে কাফের। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি হযরত ওমর (রা.)’র খিলাফত অস্বীকার করেছে, বিশুদ্ধ মতানুসারে তারাও কাফির। (ফাতওয়া আলমগীরি, খন্ড:২য়, পৃ: ২৬৪, ওয়াকারুল ফাতওয়া, খন্ড:১ম, পৃ: ২৯০)

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ কে মাহমুদুল হক : সততা ও সাহসের প্রতীক
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে