কাল আজকাল

শিক্ষামন্ত্রীর কথায় আস্থা রাখতে চাই

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২৫ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ

সময়টা ১৯৯৮/৯৯ সাল হবে হয়ত। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে লালদীঘির পাড়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সম্ভবত মে অথবা নারী দিবসের অনুষ্ঠান। সেখানে বক্তৃতা করবে স্কুল শিক্ষার্থীরা। একটি পর্যায়ে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বক্তৃতা করতে উঠলেন। বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি গৃহকর্মীদের ওপর কেমন আচরণ করা হয় তা বলতে গিয়ে বললেন, ‘আমাদের বাসায় বেশ কয়েকজন মেয়ে কাজ করে। তো বাসায় যখন আমার খালা ও ঘনিষ্ঠ নারী আত্মীয়রা বেড়াতে আসেন তখন এদের উদ্দেশে প্রায় বলেন, ‘বসে আছিস কেন? কাজ কর।মাকে উদ্দেশ করে বলতেন, ‘এদের বসিয়ে রাখবে না, মাথায় উঠে যাবে। সবাই টিভি দেখছে কিন্তু কাজের মেয়েদের শান্তিতে টিভি দেখার সুযোগ নাই। কেউ বলবে এটা কর, ওটা কর। না হলে বলবে টিভি দেখতে দেখতে মাথা টিপে দে।সভায় নিঃশঙ্কোচে, ভণিতা ছাড়া আরও বেশকিছু কথা বলেছিলেন সেদিনের কিশোর নওফেল।

মঞ্চে বসা মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী ছেলের বক্তৃতা শুনে মিটি হাসছেন আর ঘন ঘন তার দিকে তাকাচ্ছেন। বোঝা যাচ্ছে তিনি মজাই পাচ্ছেন। তবে মাঝেমধ্যে আমাদের উদ্দেশে খুব নিচু গলায় তার জনপ্রিয় গালিটি দিয়ে বলছেনও, ‘….. ঘরের কথা তো বেগ্‌গুন কই দের

সেদিন নওফেলের বক্তৃতা যাঁরা শুনেছেন তাঁরা সকলেই তাঁর অকুণ্ঠ প্রশংসা করে বলেছেন, এ ছেলে একদিন মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ছাড়িয়ে যাবে। আমিও মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। আমারও মনে হয়েছে এই ছেলে একদিন অনেক বড় হবে।

তিনি এখন আসলেই অনেক বড় হয়েছেন। মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হয়েও শিক্ষার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। এর আগে তিনি একই মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন পূর্ণমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ পাঁচ বছর একই মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন পরস্পরের মধ্যে কোনোরূপ মতদ্বৈততা ছাড়া। এই পাঁচ বছরে তিনি যে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর আস্থা অর্জন করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া গেল একই মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার মধ্য দিয়ে।

প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তাঁর কিছু কিছু বক্তব্য আমাকে আকৃষ্ট করেছে। সামপ্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় কিছু বক্তব্য আমার পছন্দ হয়েছে। তাঁর সঙ্গে আমার একবারই শুধু দেখা হয়েছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে, সম্ভবত তখন নির্বাচনী তফসিল ঘোষিত হয়নি। একাত্তর টিভির একটি টক শোতে তিনি স্টুডিওতে উপস্থিত ছিলেন। একই অনুষ্ঠানে আমি চট্টগ্রাম স্টুডিও থেকে যুক্ত হয়েছিলাম। এরপর নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়ে যেদিন প্রথম নির্বাচনী প্রচারে বের হবেন সেদিন লেখক ড. মাসুম চৌধুরী একপ্রকার জোর করে তাঁদের চশমাহিলস্থ বাসায় নিয়ে গেলেন আমাকে। সে সময় শেখ হাসিনার সরকারআবার কেন দরকারশীর্ষক একটি পুস্তিকাও বেরিয়েছে আমার। মাসুম বইটি তাঁর হাতে তুলে দিতে দিতে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। সে সময় তিনি বললেন, আমি চিনি ওনাকে। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সেদিন টক শোতে আপনি খুব ভালো বলেছেন। তাঁর স্মরণশক্তি দেখে খুব চমৎকৃত হলাম।

এবার মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর সচিবালয়ে প্রথম কর্মদিবসে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁকে যেন ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো না হয়। এতে সময়ের অপচয় হয় জানিয়ে তিনি এ ধরনের সম্মাননা বা সংবর্ধনা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ব্যতিক্রমী হিসেবে অনেকের নজর কেড়েছিল। শুধু তাই নয়, মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি চট্টগ্রামে এলেন একেবার নীরব ও নিভৃতে। সাধারণত দেখি মন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা হওয়ার পর বিমানবন্দর বা রেলস্টেশনে বিশাল আয়োজন করে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে ফুলের মালা নিয়ে শত শত নেতাকর্মী উপস্থিত হয়ে কার আগে কে মালা দেবে তার প্রতিযোগিতা করে। এখানেও তিনি ব্যতিক্রমী ছিলেন। একটি সংবাদ সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, ‘বৃহস্পতিবার রাতে সড়কপথে নিজের এলাকা চট্টগ্রামে আসেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। চট্টগ্রামে ফিরলেও ‘জনদুর্ভোগ এড়াতে’ তিনি নেতাকর্মীঅনুসারীদের কাছ থেকে কোনো সংবর্ধনা নেননি বলে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত সহকারী রাহুল দাশ। চট্টগ্রামে পৌঁছেও তিনি আরেকটি ব্যতিক্রমী কাজ করেছেন। সংবর্ধনা না নিলেও চট্টগ্রামে ফিরে রাতেই জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাড়িতে ছুটে যান নওফেল।

সেদিন রাত ১০টায় তিনি শুরুতে যান নগরীর দামপাড়া এলাকায় প্রয়াত নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বাড়িতে তার ছেলে ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে রাত সাড়ে ১০টায় যান নগরীর ফিরিঙ্গি বাজারে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ ডলফিনের বাড়িতে। এখানে আসেন নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। নওফেল তাঁর সঙ্গেও কুশল বিনিময় করেন।

দায়িত্ব নিয়েই বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তিনি। এ বছর থেকে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করছে সরকার। এটা নিয়ে একটি গোষ্ঠী শুরু থেকেই জল ঘোলা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ অপশক্তিকে আমরা চিনি। এরা স্বাধীনতাবিরোধী সামপ্রদায়িক শক্তি। তাদের ইন্ধন দিচ্ছে জামায়াতশিবির নিয়ন্ত্রিত কোচিং সেন্টারের মালিকরা। এই শক্তিটা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল। এখনও এই জাতির জন্য কল্যাণকর এমন সবকিছুরই বিরোধিতা করে এই অপশক্তি। এ প্রসঙ্গে নতুন শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘নতুন কারিকুলাম, মূল্যায়ন পদ্ধতিটা এবছর থেকে শুরু হয়েছে মাত্র। এখনো এক মাসও হয়নি। কিন্তু শুরু হওয়ার আগেই আলোচনাসমালোচনা ও অপপ্রচার। পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর আগেই ব্যাপক অপপ্রচার শুরু হয়েছিল। এখনও তো ক্লাসই সেভাবে শুরু হয়নি। অন্য দেশের ভিডিও জোড়াতালি দিয়ে কন্টেন্ট বানানো হয়েছে।’

গত এক মাসে আমাকে দুবার বাঁশখালী যেতে হয়েছিল। দুদিনই ছিল শুক্রবার। আমি দেখলাম সেখানে প্রতি আধা কিলোমিটারে অন্তত একটি মাদরাসা আছে। জুমার নামাজের পর মাদরাসার শিক্ষার্থীরা সড়কে গাড়ি থামিয়ে লিফলেট বিতরণ করে আর মাদরাসার জন্য চাঁদা তোলে। সেখানে শুক্রবার সারাদিন মাইকে ওয়াজনসিয়ত চলতে থাকে ফলে অধিকাংশ এলাকা শব্দদূষণ অবস্থায় থাকে। বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে। মাদরাসা, এতিমখানা হচ্ছে। এসব কারা করছে, কেন করছে, কোন উদ্দেশ্যে করছে, টাকা কোথা থেকে আসছে তার কোনো উত্তর নেই, কোনো জবাবদিহি নেই। এই প্রথম মন্ত্রী পর্যায়ের একজন সে প্রশ্ন তুলেছেন। ২১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ‘শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়’ বিষয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের মনিটরিংটা করতে হবে। খোলার শুরুতেই, যখন উদ্যোক্তারা আপনাদের কাছে যাবেন, তখনই আপনারা তাদের নিরুৎসাহিত করবেন। আপনি মাদ্রাসা খুলছেন, কিন্ডারগার্টেন খুলছেন, আপনি কে, আপনার ডিটেইলসটা কী, আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড কী, জানতে চাইবেন অবশ্যই। রাতারাতি ফ্লোর ভাড়া করে শুরু করে দেওয়া হলো, এভাবে তো চলতে পারে না।

বাঁশখালী উপজেলায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মতো যত্রতত্র মাদ্রাসা হচ্ছে; বিষয়টি নিয়ে উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি এসব কথা বলেন।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘ইতোমধ্যে কী পরিমাণ নূরানি মাদ্রাসা অনুমোদন দিয়েছে, সেটির তথ্য চেয়েছি। অনেকগুলোর অনুমোদনও নেই। কিন্তু চালিয়ে নিচ্ছে, চলছে। ভিক্ষাবৃত্তির কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে কিছু শিশুকে। এবতেদায়ি মাদ্রাসা কিংবা কিন্ডারগার্টেন স্কুলএগুলো খোলার আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু এটা ওরা নেয় না। সামাজিক বাস্তবতায় একটা বিদ্যালয় চালু হয়ে যাওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়াটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। খুলে দেওয়ার পরে, কাগজপত্র যদি নাও থাকে, তবুও একটা সোশ্যাল প্রেসার তৈরি হয় যে, এই বাচ্চাগুলো কোথায় যাবে।

ধর্মীয় শিক্ষার জন্য শিশুদের সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় পাঠানোর আহ্বান জানান মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে সরকারি সিলেবাস দ্বারা পরিচালিত আলিয়া মাদ্রাসা আছে। সেখানে ন্যাশনাল কারিকুলাম পড়ানো হয়। বিশেষায়িত তিনটা সাবজেক্টও পড়ানো হচ্ছে। সুতরাং আলিয়া মাদ্রাসা থাকতে কেন আমরা যততত্র নূরানি মাদ্রাসা খুলব। কেউ যদি পড়তে চায়, সে আলিয়া মাদ্রাসায় গিয়ে পড়বে। হেফজ পড়ানোর নামে মাদ্রাসা খোলা হয়, কিন্তু সেটা রেগুলার স্কুলিংয়ের বাইরে বৈকালিক বিদ্যালয় হয়ে যায়।’

তাঁর অকপট বক্তব্য আশা জাগানিয়া। জাতি ও দেশকে সঠিক পথে অগ্রসর করতে হলে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হলে আধুনিক শিক্ষা ছাড়া উপায় নেই। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। শিক্ষিত কোনো জাতি দরিদ্র থাকে না। সরকার এ বিষয়ে বিলম্বে হলেও ইতিবাচক কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি মনে করি দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে এ বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতা করা দরকার। আমার মনে হয়েছে শিক্ষামন্ত্রী নওফেল এক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দেবেন। আমি আশাবাদী হই যখন তিনি বলেন, ‘সমালোচনার ভয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে সরকার পিছপা হবে না। ভালো কিছু করার লক্ষ্যে সরকার দৃঢ়তার সঙ্গে কিছু বিষয়ে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেবে।’

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমালোচনা, অপপ্রচার ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার করণীয় নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের চ্যালেঞ্জটা একটু কমপ্লেক্স। সরকারে থাকলে চ্যালেঞ্জ একটু কমপ্লেক্স হয়। আর হ্যাঁ, কিছু সমালোচনা হবে। সেই সমালোচনা নেওয়ার সক্ষমতা রাজনীতিবিদদের থাকতে হবে। সক্ষমতা আমাদের আছে। আমরা সেটা পারব।

আমাদেরকে যে সিদ্ধান্তগুলো শিক্ষাবিদদের সাথে, বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে নেয়া হয়েছে, শুধুমাত্র সমালোচিত হব এই ভয়ে যে সিদ্ধান্ত যথার্থ এবং সঠিক সেটা নিব না, তা হতে দেওয়া যায় না। দৃঢ়ভাবে কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন আমাদের অবশ্যই করতে হবে। এটার কোনো বিকল্প নেই।’

নওফেল বলেন, ‘দেখা যায়, নেগেটিভ প্রচারণার প্রতি আমাদের দৃষ্টি বেশি থাকে। নিজেরাও অনেক সময় অজান্তে নেগেটিভ প্রচারণাতে আমরা জড়িয়ে পড়ি। সেটা কাউন্টার করাটা সারা বিশ্বব্যাপী একটা চ্যালেঞ্জ।’

তাঁর সঙ্গে গত পাঁচ বছর আমার দেখা হয়নি। আগামী পাঁচ বছর দেখা হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে আমি তাঁর সাফল্য কামনা করি। অনেক বড় দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে তাঁর স্কন্ধে। তিনি জিতলে শেখ হাসিনা জিতবেন। আর শেখ হাসিনা জিতলে বাংলাদেশ জিতবে।

লেখক : কবিসাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধগত এক বছরে যতসব অর্জন
পরবর্তী নিবন্ধজাতীয় যুব হ্যান্ডবল চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে গেল চট্টগ্রাম জেলা দল