অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নতুন কোচ ও ইঞ্জিন আমদানিসহ বিভিন্ন খাতে গত ১০ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করেও রেলের কাঙ্ক্ষিত গতি বাড়ানো যায়নি। উল্টো সুবর্ণ এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন ধরনের ট্রেনের গতি কমেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুরনো রেল লাইনগুলো সংস্কার না হওয়ায় নতুন কোচ ও ইঞ্জিন আমদানি করা হলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না। অবশ্য লাকসাম-আখাউড়া জংশনের লাইনের কাজ শেষ হলে আগামী বছরের জুন নাগাদ রেলের গতি কিছুটা বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের দায়িত্বশীল বিভিন্ন সূত্রের সাথে আলাপ করে জানা যায়, গত ১০ বছরে রেলওয়ের উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিশেষ করে রেল লাইনসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, নতুন ১০টি ইঞ্জিন ও ২০০টি কোচ আমদানি ছাড়াও জরুরি নানা খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের একমাত্র উদ্দেশ্য রেলওয়ের সেবা ও গতি বৃদ্ধি। কিন্তু দুই খাতেই রেলওয়ের মান কমেছে। সেবার মান বা নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেনের যাত্রা নিয়ে গ্রাহকদের পুরানো অভিযোগ রয়েই গেছে। নতুন নতুন কোচ ও ইঞ্জিন যুক্ত করার পর গতি বাড়ার আশা করা হলেও কার্যতঃ তা হয়নি। প্রতিটি ট্রেনই নির্ধারিত গতির চেয়ে কম গতিতে চলাচল করছে। আবার কোনো কোনো ট্রেনের ক্ষেত্রে গতি আগের তুলনায় অনেক কমেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলে বিভক্ত। চট্টগ্রাম, ঢাকা, সিলেট ও চাঁদপুরসহ বিস্তৃত এলাকা নিয়ে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল। এই অঞ্চলে ১২৭৩.৩৮ কিলোমিটার মিটার গেজ এবং ৩৪.৮৯ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ মিলে সর্বমোট ১৩০৮.২৭ কিলোমিটার রেল লাইন রয়েছে। পূর্বাঞ্চলের এই রেল লাইনের উপর দিয়ে সুবর্ণ এঙপ্রেস, মহানগর গোধূলী, তিস্তা এঙপ্রেস, পারাবত এঙপ্রেস, উপকূল এঙপ্রেস, জয়ন্তীকা এঙপ্রেস, মহানগর এঙপ্রেস, উদয়ন এঙপ্রেস, মেঘনা এঙপ্রেস, যমুনা এঙপ্রেস, অগ্নিবীণা এঙপ্রেস, কালনী এঙপ্রেস, হাওর এঙপ্রেসসহ প্রতিদিন ৪৮টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। মেইল এঙপ্রেস ও কমিউটার ট্রেন মিলে চলাচল করে ৬৬টি ট্রেন। এছাড়া কন্টেনার এঙপ্রেস চলাচল করে ৮টি। এর বাইরে পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চলের মাঝে চলাচল করে এমন ৩২টি আন্তঃনগর ট্রেনও রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটকেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই রুটে চলাচলকারী ট্রেনগুলোর গতি এবং সেবা বাড়ানোর জন্যই কার্যতঃ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু এই গতি বাড়েনি বলে মন্তব্য করে সূত্র বলছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটকে তিনটি পৃথক ভাগে ভাগ করে ট্রেন পরিচালনা করা হয়। এরমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে লাকসাম পর্যন্ত ১২৯.৬০ কিলোমিটার এলাকায় এক ধরনের গতিতে ট্রেন চলে, লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত এলাকায় চলে পৃথক গতিতে। আবার আখাউড়া থেকে ঢাকা পর্যন্ত এলাকায় চলাচল করে ভিন্ন গতিতে। চট্টগ্রাম থেকে লাকসাম পর্যন্ত এলাকায় সুবর্ণ এঙপ্রেসের সর্বোচ্চ গতি নির্ধারিত রয়েছে ৭৫ কিলোমিটার। এই গতিতেই ট্রেন চলে বলে দাবি করা হয়েছে। এই অংশে বিজয় এঙপ্রেসের গতি ৭৫ কিলোমিটার হলেও চলাচল করে ৭২ কিলোমিটার গতিতে। সাগরিকা এঙপ্রেসের ৭২ কিলোমিটার গতি নির্ধারিত থাকলেও চলাচল করে ৭০ কিলোমিটারে, চট্টলা এঙপ্রেসের ৭২ কিলোমিটারের স্থলে চলাচল করে ৭০ কিলোমিটার বেগে। পাহাড়িকা এঙপ্রেস ৭৫ কিলোমিটারের স্থলে ৭২ কিলোমিটার স্পিডে, কর্ণফুলী এঙপ্রেস ৭২ কিলোমিটারের স্থলে ৭০ কিলোমিটার স্পিডে, মহানগর এঙপ্রেস ৭৫ কিলোমিটারের স্থলে ৭২ কিলোমিটার স্পিডে এবং মহানগর গোধুলী ৭৫ কিলোমিটারের স্থলে ৭৩ কিলোমিটার স্পিডে চলাচল করে বলে কাগজেপত্রে উল্লেখ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি ট্রেনই নির্ধারিত গতির অনেক কমে চলাচল করে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা রয়েছে লাকসাম আখাউড়া জংশয় এলাকাটিতে। এখানে প্রায় প্রতিটি আন্তঃনগ ট্রেনের গতি ৭৫ কিলোমিটারে নির্ধারিত থাকলেও কোনো কোনো অংশে ২০ কিলোমিটার, কোনো কোনো অংশে ৩০ কিলোমিটার, কোনো অংশে ৪০ কিলোমিটার বেগে ট্রেনগুলো চলাচল করে। অবশ্য আখাউড়া জংশন থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রেনগুলো কিছুটা বাড়তি গতি নিয়ে চলাচল করে। লাকসাম আখাউড়া জংশন এলাকায় রেল লাইনে কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ট্রেন চলাচল কিছুটা ব্যাহত হবে উল্লেখ করে চট্টগ্রামের একজন ট্রেন চালক গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, আগামী বছরের জুন মাস নাগাদ রেল লাইন উন্নয়নের কাজ শেষ হলে ওই এলাকায়ও নির্ধারিত গতিতে ট্রেন চলাচল করতে পারবে।
হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পরও ট্রেনের গতি কমে যাওয়া প্রসঙ্গে গতকাল বাংলাদেশ রেলওয়ের পদস্থ একজন কর্মকর্তা বলেন, আসলে আমাদের লাইনগুলো দীর্ঘদিনের পুরনো। এসব লাইনের বিভিন্ন অংশে বহু সমস্যা। শত শত ব্রিজ রয়েছে। যেগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। একটি ব্রিজ পার হওয়ার জন্য বহু দূর থেকে গতি কমিয়ে আসতে হয়। আবার ব্রিজ পার হওয়ার পর নতুন করে গতি তুলতেও সময় লাগে। গতি তুলতে তুলতে আবার ব্রিজ চলে আসে। গতি কমাতে হয়। তিনি বলেন, আমাদের সর্বোচ্চ নির্ধারিত গতি প্রতি ঘণ্টায় ৭৫ কিলোমিটার। কিন্তু এই গতিতে ট্রেন চালানোর মতো রাস্তা আমাদের নেই। আমরা সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত ট্রেন চালাতে পারি। মাঝে মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় কিছু গতি বাড়লেও তা খুবই সীমিত সময়ের জন্য পারি। লাইনের উন্নয়ন না হওয়া পর্যন্ত ট্রেনে গতি আনা সম্ভব হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিষয়টি স্বীকার করে চট্টগ্রামের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা বলেছেন, রেল লাইন উন্নয়ন ছাড়া গতি আনা সম্ভব হবে না। নতুন ইঞ্জিন বা কোচ বড় কথা নয়, লাইন যথাযথভাবে ঠিকঠাক না থাকলে পূর্ণ গতিতে ট্রেন চলবে কিভাবে? ২০১৯ সালের তুলনায় আমাদের এই অঞ্চলে ট্রেনের সময় বেড়েছে ১২ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট। সময় বৃদ্ধির তালিকায় সুবর্ণ এঙপ্রেসের মতো অভিজাত ট্রেনও রয়েছে বলে তিনি জানান। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর থেকে ট্রেনে সময় বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ওই কর্মকর্তা বলেন, সমস্যা অনেক। আমাদের ৭০ শতাংশ ইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ। বর্তমানে রেলে সর্বমোট ২৬৮টি ইঞ্জিন রয়েছে। এর মধ্যে মিটারগেজ ১৭৮টি ও ব্রডগেজ ৯০টি। রেলের ইঞ্জিনের সাধারণ আয়ুষ্কাল (ইকোনমিক লাইফ) ধরা হয় ২০ বছর। এগুলোর মধ্যে বহু ইঞ্জিন রয়েছে পাকিস্তান আমলে কেনা। এসব ইঞ্জিন দিয়ে গতির স্বপ্ন দেখা কঠিন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। রেলওয়ের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, সেতুগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। অসংখ্য সেতুর অবস্থা নাজুক। যা ট্রেনের গতি থামিয়ে দেয়ার জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। রেল লাইন উন্নয়নে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, লাইন ঠিকঠাক হয়ে গেলে আমরা নির্ধারিত গতির পুরোটাই ব্যবহার করতে পারব। ফলে রেল যোগাযোগেও গাতি বাড়বে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের চট্টগ্রামের শীর্ষ একাধিক কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, সরকার রেলের উন্নয়নে বহুমুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তাই বর্তমানে কিছুটা সমস্যা হলেও ভবিষ্যতে ট্রেন চলাচলে অনেক বেশি গতিশীল হবে। বিশেষ করে ডাবল লাইন চালু হলেই সময় অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।