চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে করোনার প্রাথমিক চিকিৎসার সব ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। তবে সারাদেশে করোনার দ্বিতীয় প্রকোপ শুরু হলেও চট্টগ্রামে ১৪ উপজেলায় এখনো সেভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়নি। কিন্তু সব প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন মোহাম্মদ আসিফ খান। গতকাল চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলায় করোনার চিকিৎসা ব্যবস্থার সার্বিক চিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আজাদীকে জানান, আমাদের ১৪ উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আগে থেকেই করোনার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী রয়েছে। এর মধ্যে ৮ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা রয়েছে। উপজেলাগুলো হলো- আনোয়ারা, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, পটিয়া। এছাড়া তিন উপজেলায় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রয়েছে। উপজেলাগুলো হলো বোয়ালখালী, চন্দনাইশ ও সন্দ্বীপ। তবে ৬ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে এখনো সেন্ট্রাল আক্সিজেন ব্যবস্থা চালু করা যায়নি।
চন্দনাইশ : আমাদের চন্দনাইশ প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় দিন দিন করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. শাহিন হোসাইন চৌধুরী জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার ৭ জনসহ চলতি মাসে চন্দনাইশে ৪০ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯ জনের পজেটিভ এসেছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে যারা সংক্রমিত হয়েছেন তাদের হোম আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। তবে অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতালে প্রেরণ করা হবে।
করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও দোহাজারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট ২টি আইসোলেশন ওয়ার্ড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, আইসোলেশন ওয়ার্ডগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও আইসিইউ বেড নেই।
পটিয়া : আমাদের পটিয়া প্রতিনিধি জানান, করোনা পরিস্থিতি দিনদিন অবনতির দিকে গেলেও পটিয়ায় স্বাস্থ্যবিধি মানছে না সাধারণ মানুষ। প্রশাসনের জরিমানা থেকে বাঁচতে অফিস-আদালতে কিছু মানুষ মাস্ক পরলেও রাস্তাঘাটে অধিকাংশ মানুষই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না।
জানতে চাইলে পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সব্যসাচী নাথ জানান, পটিয়া হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য আলাদা ১৫ বেডের একটি করোনা ইউনিট রয়েছে। যেখানে পুরুষদের জন্য ৬টি ও মহিলাদের জন্য ৬টি বেড সংরক্ষিত। এছাড়া ক্যাবিন রয়েছে ৩টি। তবে হাসপাতালে কোনো আইসিইউ বেড নেই। করোনা ইউনিটের জন্য সরকারিভাবে ২২টি ও হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর দেয়া ১৮টি অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে। প্রতি রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার ২০ জন করে স্যাম্পল কালেকশন করা হয়।
উপজেলা পরিসংখ্যান কর্মকর্তা আহসান হাবিব জানান, চলতি এপ্রিল মাসের ১ তারিখ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১১০ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮ জনের করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গত দুদিনে ১৮ জনের পজেটিভ এসেছে।
পটিয়া থানার ওসি রেজাউল করিম মজুমদার জানান, জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে জরিমানা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এটা অব্যাহত থাকবে।
রাঙ্গুনিয়া : আমাদের রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় প্রতিদিন বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। সর্বশেষ গত বুধবার ৫ জনের রোগী শনাক্ত হয়েছে এখানে। গত ২৭ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩ দিনে রাঙ্গুনিয়ায় ৩৭ জনের করোনা পজেটিভ হয়েছে। এ নিয়ে উপজেলায় করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৯ জনে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎস মো. মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, রাঙ্গুনিয়ায় এ পর্যন্ত ৩৫৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯ জন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দেব প্রসাদ চক্রবর্তী জানান, হাসপাতালে করোনা আইসোলেশন বেড রয়েছে ১৪টি। হাসপাতালে করোনা রোগীদের তাৎক্ষণিক অক্সিজেন সাপোর্টসহ প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে বলে জানান তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মানতে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। এরপরও করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচতে অবশ্যই মাস্ক পড়তে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
ফটিকছড়ি : আমাদের ফটিকছড়ি প্রতিনিধি জানান, উপজেলা সদরে ২০ শয্যার হাসপাতালটি পুনরায় চালু করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে সেখানে কোভিড রোগী ভর্তি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নাবিল চৌধুরী। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ শয্যার একটি আইসোলেশন সেন্টার খোলা আছে। প্রয়োজনে আরো আইসোলেশন কেন্দ্র চালু করা হবে বলে জানান ডা. জয়নাল আবেদীন মুহুরী।
রাউজান : আমাদের রাউজান প্রতিনিধি জানান, এখানে দিন দিন করোনা রোগী বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৮ জনের পজেটিভ এসেছে। সিভিল সার্জন অফিস জানায়, উপজেলা পর্যায়ে সংক্রমণের দিক থেকে রাউজান স্থান এবং হাটহাজারী প্রথম স্থানে রয়েছে। রাউজান উপজেলা হাসপাতালে আইসিইউ না থাকলেও একটি আইসোলেশন ওয়ার্ড রয়েছে, যেখানে আছে ১৫টি বেড ও অক্সিজেনসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নুরে আলম দ্বীন বলেন, যাদের রিপোর্ট পজেটিভ আসছে তাদের কেউ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা নিতে আসছেন না। তারা নিজেদের ঘরে অথবা অন্য কোথাও আইসোলেশনে থাকছেন।
বাঁশখালী : আমাদের বাঁশখালী প্রতিনিধি জানান, বাঁশখালীতে করোনা রোগী দিনদিন বাড়লেও জনগণ মাস্ক ব্যবহার করছে না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুজ্জামান চৌধুরী উপজেলা সদরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলেও প্রভাব পড়ছে না গ্রামগঞ্জে।
বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শফিকুর রহমান মজুমদার বলেন, এ পর্যন্ত বাঁশখালীতে ৪৩৩ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এখানে হাসপাতালে ১৫ শয্যা বিশিষ্ট আইসোলেশন সেন্টার রয়েছে, তবে এখনো পর্যন্ত কোনো রোগী ভর্তি হয়নি। অন্যদিকে আইসিইউ সিট নেই কোথাও।
মীরসরাই : আমাদের মীরসরাই প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় করোনা পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে গত এক সপ্তাহে বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। মীরসসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২২ বেডের একটি আইসোলেশান সেন্টার প্রস্তুত থাকলেও কেউ এখানো ভর্তি হননি। তবে আক্রান্তরা বাসা কিংবা শহরের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সন্দ্বীপ : উপজেলায় করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। দ্বিতীয় ঢেউ এখানে তেমন একটা অনুভূত হয়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফজলুল করিম দৈনিক আজাদীকে বলেন, আল্লাহর অশেষ রহমতে এখানে পরিস্থিতি চট্টগ্রামের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেকটা ভালো। তিনি বলেন, গত ১ এপ্রিল এখান থেকে ৯ জনের নমুনা পাঠানো হয়েছে, সেখানে ৩ জনের পজেটিভ এসেছে। তারা হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। সন্দ্বীপ হারামিয়া ২০ শয্য বিশিষ্ট হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং গাছুয়ায় হাসপাতালে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা আছে বলে জানান ডা. করিম।
সাতকানিয়া : আমাদের সাতকানিয়া প্রতিনিধি জানান, সাতকানিয়ায় করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ পর্যন্ত ৩৩৭ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না বেশিরভাগ মানুষ। সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০ শয্যা বিশিষ্ট আইসোলেশন সেন্টার রয়েছে। তবে সেখানে বর্তমানে কোনো করোনা রোগী নেই। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ সাতকানিয়ায় কোনো হাসপাতালে আইসিইউ ব্যবস্থা নেই।
সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আবদুল মজিদ ওসমানী জানান, সাতকানিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেন্ট্র্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থাসহ ২০ শয্যা বিশিষ্ট আইসোলেশন সেন্টার প্রস্তুত রয়েছে। তবে এ মুহূর্তে কোনো করোনা রোগী ভর্তি নেই। রোগী আসলে আমরা চিকিৎসা দিতে পারব।
লোহাগাড়া : সর্বশেষ এই উপজেলায় ১২ জনের নমুনায় ৫ জনের রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। আক্রান্তরা হোম আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেয়ার মতো কোনো রোগী এখনো পাওয়া যায়নি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেন্ট্রাল অক্সিজেনসহ ২০ শয্যা বিশিষ্ট আইসোলেশন ব্যবস্থা রয়েছে। তবে আইসিইউ বেড নেই।
লোহাগাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ হানিফ জানান, করোনা আক্রান্ত থেকে রক্ষা পেতে সামাজিক দূরত্ব বজায়, মাস্ক ব্যবহার ও সাবান দিয়ে হাত ধৌত করতে হবে। এছাড়া সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
হাটহাজারী : আমাদের হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, উপজেলার আওতাধীন ১৪টি ইউনিয়ন, ১টি পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন বাড়ছে। সচেতনতার অভাবে স্বাস্থ্য বিধি না মানা এবং ক্ষেত্রে বিশেষে ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপারে ভুল তথ্য ও নানামুখী বিভ্রান্তির কারণেই এ উপজেলায় রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এ এস এম ইমতিয়াজ হোসাইন বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা রোগীদের জন্য আলাদা ১০টি বেড রয়েছে। বর্তমানে ৩ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাছাড়া দুজন সন্দেহজনক রোগী ভর্তি রয়েছেন। এখানে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে ২৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। সর্বমোট আক্রান্তের সংখ্যা ১ হাজার ৪শ ৩ জন।
সীতাকুণ্ড : আমাদের সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি জানান, সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০টি আইসোলেশান বেড থাকলেও কোনো রোগী ভর্তি নেই। এছাড়া এখানে কোনো আইসিইউ বেড নেই। তবে এখানে সেন্ট্রাল হাই ফ্লু অক্সিজেন সেবা পাওয়া যায়।
সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে ৬৫ জন নমুনা দিয়েছেন। এর মধ্যে ৭ জন পজেটিভ শনাক্ত হয়েছেন। তারা নগরীতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।
সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নুর উদ্দিন রাশেদ জানান, সীতাকুণ্ডে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এজন্য সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে।