বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য নতুন। সিস্টেমেটিকলি এরকম প্রোগ্রাম আগে মুখোমুখি করা হয়নি। মুখোমুখি হলেও প্রচেষ্টা করা হয়নি। এ প্রথম আমরা করছি। এটার জন্য আমরা নিজেরাই শিখছি কীভাবে করতে পারি। এটা তো আর দেশের আইনে হবে না। বিদেশিদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ স্থাপন করতে হবে। তাদের আইনের সাথে সঙ্গতি রেখেই আমাকে কাজগুলো করতে হবে। এভাবেই পাচার করা অর্থ আনতে হবে। গতকাল বিকেলে নগরীর কোতোয়ালীতে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রথম ধাপে চেষ্টা করতে হবে সম্পদগুলো চিহ্নিত করা। সেই ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ করছি। আইনি সহায়তার জন্য আমরা চিঠি পাঠাচ্ছি। বিভিন্ন ল’ ফার্মের সাথে কথা বলছি, তাদের হয়তো খুব শিগগির হায়ার করবো। যারা কার সম্পদ কোথায় আছে তা বের করবে। আমরা ভাসা ভাসা জানি সিঙ্গাপুরে আছে, অমুক দেশে আছে। সঠিক তথ্য না পেলে আদালতে টিকবে না। কাজেই আমাকে সেইভাবে তথ্য নিয়ে আসতে হবে। সেই জন্য বিদেশি অ্যাসেট ট্রেসিং ফার্মের মাধ্যমে তাদের ব্যাংক হিসাব, কোম্পানি ও সম্পদ শনাক্ত করতে হবে। আমরা যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছি বিদেশিদের কাছ থেকে। তারপরেও জিনিসটা এত সহজ নয়, সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আমাদের লক্ষ্য ছয় মাসের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে সম্পদ শনাক্ত করা। এরপর আদালতে যেতে হয়। কয়েক বছর লেগে যায়। চট্টগ্রামেরই একটি বড় শিল্পগ্রুপ অন্তত সোয়া এক লাখ বা দুই লাখ কোটি টাকার মতো অর্থ পাচার করেছে, শুধু ব্যাংকিং খাত থেকে। সেরকম আরও বেশকিছু আছে। বেক্সিমকো পাচার করেছে ৫০ হাজার কোটি টাকার মতো। সব মিলিয়ে আড়াই থেকে তিন লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। এগুলো বড় গ্রুপ। ছোটগুলো আমি ধরছি না। অপরিশোধিত ঋণ আছে প্রায় পাঁচ লাখ কোটি টাকার মতো। সব পাচার হয়ে গেছে আবার তাও নয়। দেশের ভেতরেও আছে। সেগুলো উদ্ধার করতে হবে অন্যভাবে।
পাচার করা অর্থ ফেরতের প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের করা এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই আউট অব কোর্ট সেটেলমেন্ট বলে একটা কথা আছে। আমাদেরও করতে হবে। সবসময় মামলায় জড়িয়ে দীর্ঘসূত্রতায় যাওয়ার কোনো মানে হয় না। যদি প্রতিপক্ষকে ভালোভাবে ধরা যায়, তাহলে আপোষটা ভালোভাবে হয়। ধরতে না পারলে ভালোভাবে ধরা যাবে না। আপোষে যেতে হলে তথ্য ভালোভাবে নিতে হবে। তথ্যের কোনো গরমিল থাকা যাবে না।
অর্থ পাচারে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেকে জড়িত আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে গভর্নর বলেন, অমূলক তথ্যের ভিত্তিতে কাউকে চাকরিচ্যুত করার পক্ষে আমি নই। সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ থাকলে আমরা ব্যবস্থা নেব। দুদক বা রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা যদি তথ্য প্রমাণ দেয় যে কেউ জড়িত আছে আমরা ব্যবস্থা নেব। যাদের বিরুদ্ধে তথ্য আছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো এখন অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমরা আশা করি ব্যাংকগুলো একটি সুদৃঢ় অবস্থানে চলে যাবে। ইসলামী ব্যাংক বিশালভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখানে ডিপোজিট গ্রোথ খুব ভালো। রেমিটেন্সের প্রবাহ আবার বাড়া শুরু করেছে।
গভর্নর বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে সামগ্রিক অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। আমরা মনে করি, আমরা সেখানে বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছি, পুরোপুরিভাবে হয়নি। আরও হবে আশা করি। আমরা সঠিক পথে আছি। আমাদের রিজার্ভ স্থিতিশীল আছে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। আমাদের রপ্তানি বাড়ছে। বিভিন্ন রকমের গোলযোগ আন্দোলন সত্ত্বেও রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়েনি, বাড়ছে। ডাবল ডিজিট গ্রোথ দেখতে পাচ্ছি। রেমিটেন্সের প্রবাহ উৎসাহব্যঞ্জক। এর ধারাবাহিকতা থাকবে বলে আশা করছি। সব মিলিয়ে ম্যাক্রো ইকোনমিক এঙটারনাল সেক্টরে একটা স্বস্তির জায়গায় আমরা চলে এসেছি। কোনো ধরনের কোনো রকমের ক্রাইসিস আছে বলে আমি মনে করি না এবং হবে বলে আমি মনে করি না। আমরা একটা সুদৃঢ় অবস্থানে এসেছি। মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টা চলমান। আমাদের প্রচেষ্টা আংশিকভাবে সফল হয়েছে। আপনারা জানেন, আগস্ট মাসে যখন প্রথম নতুন তথ্য আসলো, আগে তথ্য নাকি কমই দেখানো হতো। প্রথম ছেড়ে দেওয়া হলো। খাদ্যে সেপ্টেম্বরে সাড়ে ১৪ শতাংশ। গত মাসে ৮ শতাংশের একটু বেশি আছে। মোটামুটি সন্তোষজনক। নন ফুড সাড়ে ১২ থেকে কমে এখন সাড়ে ৯ শতাংশে নেমেছে। আমি আশাবাদী, এটা আরও কমবে সামনে। সাধারণত খাদ্য মূল্য বাড়লেই নন ফুড মূল্যস্ফীতিও বাড়ে। খাদ্য মূল্য বাড়লে রিকশা ভাড়া, বাড়ি ভাড়া, চুল কাটার খরচ ক্রমে বাড়ে। খাদ্য মূল্য কমলে তখন আবার নন ফুড আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। সামগ্রিকভাবে আমরা একটা স্বস্তির জায়গার দিকে যাচ্ছি। জুনের শেষে, জুলাই মাসে রেজাল্ট পাবো মূল্যস্ফীতি হয়তো ৭–৮ এর মধ্যে পাবো। ইনশাআল্লাহ আগামী বছর এটাকে ৫ বা তার নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে।
পলিসি রেসপন্সে সময় লাগে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওষুধ দিলেই সব রোগী ভালো হয়ে যায় না, সময় লাগে। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি সব সার যেন সময়মতো আসে। বোরো ধার বুনতে যেন কোনো অসুবিধা না হয় কৃষকের। বিদ্যুতের সরবরাহ যেন বিঘ্নিত না হয়। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকা সত্ত্বেও আমরা তা করতে পেরেছি। আমাদের নিজের টাকাতেই করেছি।
বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রামের উপ পরিচালক জোবাইর হোসেনের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংক চট্টগ্রামের নির্বাহী পরিচালক জামাল উদ্দিন, পরিচালক সালাহ উদ্দীন, আরিফুজ্জামন, আশিকুর রহমান, স্বরুপ কুমার চৌধুরী ও ফাইন্যান্স ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের পরিচালক আনিসুর রহমান।