স্থগিত থাকা পাঁচ বছর পূর্বের ‘বর্ধিত’ গৃহকর আদায়ে কার্যক্রম শুরু করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এ লক্ষ্যে চসিকের ৮টি রাজস্ব সার্কেল থেকে হোল্ডিং মালিকদের ধার্য করা গৃহকরের নোটিশ পাঠানো হচ্ছে। অবশ্য ভবন মালিকদের কারো আপত্তি থাকলে আইন অনুযায়ী আপিল করার সুযোগ আছে। আপিল করলে কর সহনীয় করার আশ্বাস দিয়েছেন সিটি মেয়র।
জানা গেছে, চসিকের পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন শেষে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে নগরের সরকারি-বেসরকারি ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ২৪৮টি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে ৮৫১ কোটি ৩০ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৯ টাকা পৌরকর আদায়ের প্রস্তাব করা হয়, যা পূর্বে ছিল ১৩১ কোটি ৯১ লাখ ৮৭ হাজার ৪১ টাকা। অর্থাৎ এক লাফে ৫৪৫ দশমিক ৩২ শতাংশ গৃহকর বৃদ্ধি পায়। তবে নগরবাসীর আপত্তির পর মন্ত্রণালয় স্থগিতাদেশ দেয়ায় ‘বর্ধিত’ সেই গৃহকর আদায় করেনি চসিক। ৫ অর্থবছর পর চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছর থেকে পুরনো সেই গৃহকর আদায়ে কার্যক্রম শুরু করল চসিক। এর ফলে বাড়তে পারে ‘করের বোঝা’। করদাতারা বলছেন, পূর্বে ভবনের মূল্যায়ন করা হতো বর্গফুটের ভিত্তিতে। কিন্তু ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে রিঅ্যাসেসমেন্ট করা হয় ভবনের ভাড়া বা আয়ের বিপরীতে। এতে এক লাফে কর বহু গুণে বেড়ে গিয়েছিল। এখন বর্ধিত সে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় শুরু হলে ভবনমালিকদের পাশাপাশি চাপে পড়বেন ভাড়াটিয়ারাও। কারণ গৃহকরের অজুহাতে বাসাভাড়াও বাড়তে পারে।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, আগেও বলেছি, এখনো বলছি, গৃহকর বাড়াব না। আইনগত কারণে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের অ্যাসেসমেন্টের আলোকে প্রস্তাবিত গৃহকর আদায়ে প্রক্রিয়া শুরু করতে হলো। এজন্য বিল দেয়া শুরু হয়েছে। তবে কারো আপত্তি থাকলে আপিল করতে পারবেন। আমরা সর্বোচ্চ ছাড় দেব, যাতে কর সহনীয় পর্যায়ে আসে। নগরবাসীর কাছে আহ্বান থাকবে তারা যেন আপিল করেন। অসহনীয় ভেল্যুয়েশন থাকলে আপিলে তা কমানো হবে। আমরা চাচ্ছি গৃহকর পরিমাণে কম হলেও নগরবাসী যেন নিয়মিত পরিশোধ করে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ২৮ মার্চ অনুষ্ঠিত চসিকের বর্তমান পর্ষদের ১৪তম সাধারণ সভায় ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের স্থগিতকৃত গৃহকর মূল্যায়নের আলোকে ২০২২-২০২৩ অর্থবছর থেকে কর আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়। এতে চলতি জুলাই মাস থেকে তা কার্যকরের কথা বলা হয়। এরপর ২৭ এপ্রিল চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম ৮টি পৃথক সার্কেলের কর কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে হোল্ডিং মালিকদের বিল দেয়ার নির্দেশনা দেন। এতে বলা হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের বিপরীতে গৃহকর ও রেইটের দাবি বিল সংশ্লিষ্ট কর আদায়কারীর মাধ্যমে জারি নিশ্চিতকরণ ও উপ-কর কর্মকর্তা (কর) দাবি বিল জারির বিষয়ে তদারক করবেন। এর প্রেক্ষিতে চলতি মাসের শুরু থেকে সংশ্লিষ্ট হোল্ডিং মালিকদের ধার্য করা গৃহকরের নোটিশ পাঠানো হচ্ছে বলে পৃথক তিনটি সার্কেলের কর কর্মকর্তা আজাদীকে জানিয়েছেন।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত ২ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রস্তাব দেয় চসিক। পরদিন সিটি মেয়রের নির্দেশে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে চসিকের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ শহীদুল আলম এ বিষয়ে সহযোগিতা চান। এর প্রেক্ষিতে ১৮ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। অবশ্য বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার চার মাসের মাথায় ২০২০ সালের ৩ জুনও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল চসিক।
জানা গেছে, দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাঙেশান রুলস অ্যাক্ট ১৯৮৬-এর ২১ ধারা মতে, সিটি এলাকায় প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সকল প্রকার স্থাপনার পরিমাপ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য সরেজমিন সংগ্রহ করে পৌরকর নির্ধারণ করা হয়। আইনটির আলোকে ২০১৬ সালে গৃহ ও ভূমির পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন করে চসিক। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২০ মার্চ প্রথম দফায় নগরের ১১টি ওয়ার্ডে অ্যাসেসমেন্ট শুরু করে এবং একই বছরের ২০ জুন শেষ হয়। দ্বিতীয় দফায় একই বছরের ১৮ অক্টোবর বাকি ৩০টি ওয়ার্ডে অ্যাসেসমেন্ট শুরু করে এবং তা শেষ হয় ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি। পুনর্মূল্যায়ন শেষে তা ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়।
চসিকের অ্যাসেসমেন্টের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর প্রস্তাবিত পৌর করের বিরুদ্ধে আপত্তি জানান ভবন মালিকরা। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তারা মাঠে নামেন। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ নামে একটি সংগঠন ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে। প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী ও সাবেক মেয়র মনজুর আলমও এর বিরোধিতা করেন। ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর গৃহকর বৃদ্ধি করায় জাতীয় সংসদেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মন্ত্রী-এমপিরা।
এরপর একই বছরের ২৬ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন মন্ত্রণালয়টির শীর্ষ কর্মকর্তারা। এতে সারা দেশের গৃহকর কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় না আসা পর্যন্ত অ্যাসেসমেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়, যা ১০ ডিসেম্বর চসিককে পত্র দিয়ে জানিয়ে দেয় মন্ত্রণালয়। অবশ্য এর আগে মৌখিক নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২৭ নভেম্বর থেকে অ্যাসেসমেন্ট কার্যক্রম স্থগিত করেছিল চসিক। স্থগিতের আগের দিন পর্যন্ত ৬৭ হাজার ৩৫২ জন হোল্ডার আপিল করেন। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৭৮টি আপিল নিষ্পত্তিও করা হয়ছিল।
পরে ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর চসিকের তৎকালীন প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থগিত হওয়া রিঅ্যাসেসমেন্টের আলোকে পৌরকর আদায়ে প্রস্তাব দেন। এর প্রেক্ষিতে ২৫ অক্টোবর সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারও করে নেয় মন্ত্রণালয়। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে পূর্বের স্থগিতাদেশ বহাল থাকায় সাধারণ ভবন মালিকরা রক্ষা পায় ‘অতিরিক্ত’ করের বোঝা থেকে। এখন সেটাও কার্যকর হতে চলল।
চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক ও মুখপাত্র হাসান মারুফ রুমী আজাদীকে বলেন, স্থগিত থাকা গৃহকর আদায় কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে আমরা অবগত। বিষয়টি নিয়ে আমরা বসেছি। শীঘ্রই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামব।
উল্লেখ্য, চসিকের নিজস্ব আয়ের মূল উৎস পৌরকর। সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই চসিক মোট ১৭ শতাংশ পৌরকর আদায় করে থাকে। তার মধ্যে ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাঙ (গৃহকর), ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন রেইট এবং ৭ শতাংশ আবর্জনা অপসারণ রেইট রয়েছে।