ফেসবুকে পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে নগরের হাজারী গলিতে দোকানপাটে হামলা–ভাঙচুর, উত্তেজনা সৃষ্টি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা ও এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় কোতোয়ালী থানার এসআই মিজানুর রহমান বাদী হয়ে গতকাল মামলা দায়ের করেন। এতে ৪৯ জনের নাম উল্লেখ করে ৫০০–৬০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এর আগে ঘটনার পর মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ৮২ জনকে আটক করে যৌথ বাহিনী। এর মধ্যে যাচাই–বাছাই শেষে ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার এবং ৩৩ জনকে পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়। এদিকে গতকাল হাজারী গলিতে উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। দিনভর দোকানগুলো ছিল বন্ধ। কয়েকটি জুয়েলারি দোকান সিলগালা অবস্থায় রয়েছে।
যৌথ বাহিনীর বক্তব্য : ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে গতকাল যৌথ বাহিনী এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) সংবাদ সম্মেলন করে। এর মধ্যে দুপরে ১২টায় নগরের দামপাড়ায় সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড কার্যালয়ে যৌথবাহিনীর সংবাদ সম্মেলনে টাস্কফোর্স–৪–এর মুখপাত্র লেফট্যানেন্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ বলেন, মঙ্গলবার বিকেল ওসমান আলী নামে এক ব্যক্তির ইসকন বিরোধী একটি ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে হাজারী লেনে উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং আনুমানিক ৫০০–৬০০ জন দুস্কৃতকারী হাজারী লেনে ওসমান আলী ও তার ভাইকে হত্যা এবং দোকান জ্বালিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে জড়ো হয়। স্থানীয় কন্ট্রোল রুম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং বিজিবি সদস্যদের ৬টি টহল দল ওই এলাকায় পেঁৗঁছায়। বিশৃক্সখলাকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় জানমাল রক্ষা এবং মব জাস্টিস রোধে যৌথবাহিনী ওসমান আলী ও তার ভাইকে উদ্ধার করে। উত্তেজিত জনতাকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাধানের বিষয়টি আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও এক পর্যায়ে উগ্র বিশৃক্সখলাকারীরা আরো আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।
লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ বলেন, দুর্বত্তরা যৌথবাহিনীর ওপর অতর্কিতভাবে জুয়েলারির কাজে ব্যবহৃত এসিড হামলা চালায় এবং ভারী ইট–পাটকেলসহ ভাঙা কাঁচের বোতল ছুঁড়তে শুরু করে। এতে সেনাবাহিনীর ৫ জন ও ৭ পুলিশ সদস্য আহত হন। সেনাবাহিনীর পাঁচ সদস্যকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল চট্টগ্রামে চিকিৎসা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও, ঘটনাস্থলে দুর্বৃত্তরা ইট ছুঁড়ে সেনাবাহিনীর একটি পিকআপ ভ্যানের উইন্সীল্ড ভেঙ্গে ফেলে।
লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ বলেন, উদ্ধার অভিযানের পর দুুর্বৃত্ত সনাক্তকরণে যৌথবাহিনীর ১০টি টহল দল আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে হাজারী লেন এলাকায় ঢুকলে লুকিয়ে থাকা দুষ্কৃতকারীরা পুনরায় যৌথবাহিনীর ওপর এসিড সদৃশ বস্তু ছুঁড়তে শুরু করে। এসময় যৌথবাহিনী ঘটনাস্থল থেকে ৮০ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক করতে সমর্থ হয়। সিসিটিভি ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্য যাচাই–বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রকৃত দুষ্কৃতকারীদের চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে এবং হাজারী গলিসহ নগরীর অন্যান্য এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। আমরা নজরদারি রেখেছি। হাজারী লেনসহ শহরের অন্যান্য জায়গাতেও আমাদের নজরদারি আছে। এগুলো তদন্তের বিষয়। তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান। ওখান থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, যেহেতু ওই এলাকায় দোকান থেকে সেনা ও পুলিশ সদস্যের ওপর এসিড নিক্ষেপ করা হয়েছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কয়েকটি দোকান সিলগালা করা হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্টতা খুঁজছি। দ্রুত তদন্ত শেষ করে দোকানগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম নিশ্চিত করা হবে।
আটক ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, দুষ্কৃতকারীদের কোনো পলিটিক্যাল পরিচয় আসলে থাকে না। তাদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ নেই।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র্যাব) ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট মো. সাইফুল্লাহ, নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি–মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ–৮ এর সহকারী পরিচালক মো. শফিউল্লাহ, আনসারের উপ–সহকারী পরিচালক সুলতানা পারভীন।
সিএমপির বক্তব্য :
দোকানপাটে হামলা ভাঙচুর, উত্তেজনা সৃষ্টি, আইনশৃক্সখলা বাহিনীর ওপর হামলা–এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় সনাতন ধর্মবিশ্বাসী সংগঠন ইসকন সমর্থকরা জড়িত থাকার প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে বলে জানিয়েছেন সিএমপির উপ–কমিশনার (অপরাধ) রইছ উদ্দিন।
গতকাল বিকেলে দামপাড়া পুলিশ লাইনে আয়োজিত সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তারা জয় শ্রীরাম বলে স্লোগান দিয়েছে। আর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে, তদন্ত ও গোয়েন্দা তথ্য বিচার–বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছি, এ ঘটনায় ইসকন সমর্থকরাই জড়িত। ইসকনকে নিয়ে দেওয়া একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ওসমান আলী নামে এক ব্যক্তিকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে– এমন তথ্য ৯৯৯–এ পেয়ে আমাদের কোতোয়ালী থানা পুলিশ রেসপন্স করে। তারা সেখানে গেলে অবরুদ্ধ ওসমানকে উচ্ছৃক্সখল জনতা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরিস্থিতির অবনতি হলে সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ এবং সেনাসদস্যরাসহ অন্যান্য আইনশৃক্সখলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হন। ছিনিয়ে নেওয়ায় বাধা দেওয়ায় উচ্ছৃক্সখল জনতা আইনশৃক্সখলা বাহিনীর ওপর ইট–পাটকেল ও এসিড নিক্ষেপ শুরু করে। এতে আমাদের ৯ জন সদস্য আহত হন, যার মধ্যে একজন এসিডদগ্ধ হয়েছেন। হামলার ঘটনায় ৮২ জনকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে বলেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ইসকন সমর্থক। কয়েকজন মুসলিম থাকতে পারে। এটিও যাচাই–বাছাই চলছে।
রইছ উদ্দিন বলেন, কোনো রাজনৈতিক মদদ রয়েছে কি না সেটা তদন্ত করা হচ্ছে। আটক করা হয়েছে যাদের, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। শান্ত নগরীকে যারা বিশৃক্সখল করতে চায় তাদের বিষয়ে আমাদের কার্যক্রম চলমান। কোনো ছোট–খাটো ইস্যুকে কেন্দ্র করে যেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে ব্যাপারে আমরা তৎপর আছি। এ ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
সংবাদ সম্মেলনে আহত ৯ পুলিশ সদস্যদের পরিচয় তুলে ধরা হয়। তারা হচ্ছেন– নগর পুলিশের কোতোয়ালী জোনের সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান এবং পুলিশ সদস্য সাইফুল ইসলাম, বিপ্লব বেপারি, আবু সায়েম সেজান, সাইদ হাসান, ফয়েজ, নাইম, আশিকুর ও শাহজাহান হোসেন শাওন। এরমধ্যে ফয়েজ এসিডদগ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।