দেশের সরকারি–বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংকের প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের এলসি পেমেন্ট আটকা রয়েছে। সাধারণত এলসি পেমেন্ট ৭ থেকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন হয়। কিন্তু এর মধ্যে কিছু ব্যাংকের পেমেন্টের সময় প্রায় এক বছর হতে চলল। বিদেশ থেকে পণ্য এনে তা বন্দর থেকে খালাস করে বিক্রি করে দেওয়া হলেও বিদেশি সরবরাহকারী পণ্যের মূল্য না পাওয়ায় দেশের ব্যবসায়ীদের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এলসি পেমেন্ট না দেওয়ায় আমদানিনির্ভর দেশের আমদানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের অন্তত ৩৩ কোটি টাকার এলসি পেমেন্ট পেতে দুবাইভিত্তিক জ্বালানি গ্যাস সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানকে মাসের পর মাস ঘুরতে হচ্ছে। ওই ব্যবসায়ী বাংলাদেশে আর কখনো বকেয়ায় গ্যাস বিক্রি করবেন না বলে হুমকি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ১৮ ডিসেম্বর বলেছিলেন, এক মাসের মধ্যে সব এলসি পেমেন্ট পরিশোধ করা হবে। তিনি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশও দিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কোটি কোটি টাকার এলসি পেমেন্ট ঝুলে রয়েছে।
জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি করার ক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধ করা হয় লেটার অব ক্রেডিট বা এলসির মাধ্যমে। একজন আমদানিকারক তার পছন্দের ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলেন। ওই ব্যাংক বিদেশি ব্যাংকে পণ্যমূল্য পরিশোধ করে। বিদেশি সরবরাহকারী তার ব্যাংক থেকে পণ্যের মূল্য পেয়ে থাকেন। প্রচলিত এই নিয়মে আমদানি বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু বিগত সরকারের সময়কালে অর্থপাচারসহ নানা কারণে দেশে ডলারের সংকট দেখা দেয়। এলসি পেমেন্ট দেওয়ার মতো ডলারের অভাবে ব্যাংকগুলো এলসি খোলা অনেকটা বন্ধ করে দেয়। কোনো কোনো ব্যাংক জরুরি কিছু পণ্যের এলসি খোলে। আবার কোনো ব্যাংক এলসি খুলে পণ্য আনালেও বিদেশি সরবরাহকারীর এলসি পেমেন্ট করতে ব্যর্থ হয়। এতে করে বিদেশি সরবরাহকারীরা তাদের পাঠানো পণ্যের মূল্য না পেয়ে বাংলাদেশের আমদানিকারকদের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি পেমেন্ট আটকে রয়েছে। দেশের বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও আমদানিকারকরা বলছেন, এলসি নিষ্পত্তিতে ২ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত সময় লাগছে, যেখানে সাধারণত ৭ থেকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে এটি সম্পন্ন হয়। কিন্তু কিছু কিছু এলসির পেমেন্ট প্রায় এক বছরেও হচ্ছে না।
এই ধরনের একটি ইস্যুতে দেশে এলপিজি সরবরাহ হুমকির মুখে পড়ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের এলপিজি সরবরাহকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান কামজার জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি থেকে প্রায় ৩৩ কোটি টাকার এলপিজি আমদানি করে বাংলাদেশের গ্রিন টাউন এলপিজি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। জনতা ভবনের জনতা ব্যাংক কর্পোরেট শাখা গত বছরের ৩০ এপ্রিল এলসি নম্বর ০১৩২২৪০২০০২৪ মূলে ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯ দশমিক ৭৫ ডলার এবং ৩০ জুন এলসি নম্বর ০১৩২২৪০২০০৩৫ মূলে ১৩ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৬ দশমিক ৬৪ ডলার মিলে ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৮৬৬ দশমিক ৩৯ ডলারের এলসি খোলে। জনতা ব্যাংক কর্পোরেট শাখা উক্ত এলসির পেমেন্ট দেওয়ার কথা সংযুক্ত আরব আমিরাতের ব্যাংক ফার্স্ট আবুধাবি ব্যাংককে। উক্ত এলসির আওতায় আমদানিকারক গ্রিন টাউন এলপিজি সময়মতো এলপিজির চালানটি খালাস করে বাজারে বিক্রি করে দেয়। কিন্তু ব্যাংক সরবরাহকারীর এলসি পেমেন্ট করেনি। গত বছরের ১৪ জুন এবং ১৪ আগস্ট উক্ত দুটি এলসি পরিশোধের নির্ধারিত তারিখ ছিল। কিন্তু এরপর থেকে ব্যাংক এলসি পেমেন্ট ঝুলিয়ে রেখেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কামজার জেনারেল ট্রেডিং এলএলসির পক্ষ থেকে ব্যাংকের নিকট একাধিকবার পত্র দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি জানানো হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের। তারপরও বিদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি তাদের পাওনা প্রায় ৩৩ কোটি টাকার এলসির অর্থ পায়নি।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উক্ত গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বাকিতে গ্যাস দেবে না বলে হুমকি দিচ্ছে। একই সাথে বিষয়টি বিদেশি বিভিন্ন সরবরাহকারীর মাঝে ছড়িয়ে পড়ায় দেশের আর্থিক খাতের ইমেজ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
চট্টগ্রামের একজন শীর্ষ আমদানিকারক বলেন, আমরা পণ্য কিনছি, কিন্তু ব্যাংক পেমেন্ট নিশ্চিত করতে পারছে না। এতে শুধু ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে না, ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক লেনদেনও হুমকির মুখে পড়ছে। অনেক বিদেশি সরবরাহকারী এখন আগাম অর্থ ছাড়া চালান পাঠাতে রাজি হচ্ছেন না। এলসি পেমেন্টে বিলম্বের কারণে দেশের আর্থিক খাতের ইমেজও প্রশ্নের মুখে পড়ছে। তিনি বলেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন অনেক ভালো। ২৬ বিলিয়ন ডলারের উপরে চলে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেখানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এলসি পেমেন্ট নিশ্চিত করার কড়া নির্দেশ দিয়েছেন সেখানে কিছু সরকারি–বেসরকারি ব্যাংক যা করছে তাতে শুধু আমদানি বাণিজ্যের নয়, দেশেরও সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
আমদানিকারকরা বলেন, এলসি পেমেন্টে বিলম্ব হলে এর বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে বসে। দেশে ডলারের সংকট প্রায় কেটে গেলেও কিছু কিছু ব্যাংকের জন্য বাংলাদেশ এখন সেই ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার বিরোধী একটি ষড়যন্ত্রও সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। শুধু এই দুটি এলসি নয়, জনতা ব্যাংকের আরো বেশ কিছু এলসি পেমেন্ট আটকে রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। জনতা ব্যাংকের পাশাপাশি আরো কয়েকটি সরকারি–বেসরকারি ব্যাংকের এলসি পেমেন্ট ঝুলে রয়েছে; যার পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি ডলার।
এ বিষয়ে কথা বলতে ফোন করা হয় জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। ম্যাসেজ দেওয়া হলেও তিনি উত্তর দেননি।
ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেশ কিছু এলসি পেমেন্ট আটকে রয়েছে। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংক এলসি পেমেন্ট দিতে পারছে না। আগামী কিছুদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এসব এলসির পেমেন্ট অচিরেই দেওয়া হবে।