করোনাকালে ধসে পড়া রাজস্ব আয়ের বিপর্যয় ঠেকাতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে নানা বাহানায় আটকে থাকা ৩২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব উদ্ধারে মাঠে নামছে প্রশাসন। বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকা এসব অর্থ আদায় করতে প্রয়োজনে কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মামলা মোকদ্দমা মোকাবেলার জন্য আইনি শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি বিকল্পপন্থা নিয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র এই খবর জানিয়েছে।
এনবিআর-এর পদস্থ একজন কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বিশাল অংকের এই আয় আসবে মূলত আয়কর, ভ্যাট এবং আমদানি ও রপ্তানি শুল্ক থেকে। কিন্তু করোনাকালে ইতোমধ্যে নানাভাবে রাজস্ব আয়ে ধস পরিলক্ষিত হচ্ছে। আয়করের পরিমাণ কমেছে। কমেছে ভ্যাট আহরণের পরিমাণও। রপ্তানি আয়েও দেখা দিয়েছে ধস। সবকিছু মিলে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্য নিয়ে সরকার অগ্রসর হচ্ছে ভয়াল করোনা তাতে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে রাজস্ব আদায়ের বিদ্যমান পরিস্থিতি একটি সংকটজনক অবস্থা তৈরি করবে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হচ্ছে।
সূত্রটি জানায়, রাজস্ব আয়ের মারাত্মক এই নেতিবাচক অবস্থায়ও বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে শত শত কোটি টাকার শুল্ক আটকা রয়েছে। মামলা-মোকদ্দমাসহ নানা অজুহাতে আটকে রাখা হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকা। ২২ হাজারেরও বেশি মামলায় এই অর্থ আটকা পড়েছে। এরমধ্যে আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক রয়েছে। এই টাকা উসুল করা সম্ভব হলে তা রাজস্ব আয়ের ঘাটতি পোষানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। আর এই লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির উপর গুরুত্বারোপ করছে। প্রয়োজনে আইনি শক্তি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাম্প্রতিক এক উচ্চ পর্যায়ের সভায় মামলা-মোকদ্দমার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এবং আইনি শক্তি বাড়িয়ে বছরের পর বছর ঝুলে থাকা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার উপর জোর দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, বিরাজমান আইনে শুল্ক বা ভ্যাট নিয়ে যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মামলা করতে পারে। দুই ধরনের মামলার বিধান রয়েছে। যে কেউ ইচ্ছে করলে এনবিআরের অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আপিল কিংবা উচ্চ আদালতে রিট করতে পারেন। উচ্চ আদালত রিট খারিজ করে এনবিআরে পাঠাতে পারেন। ওই অবস্থায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এনবিআরের অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারেন। তবে এই আবেদনের সাথে দাবিকৃত অর্থের ১০ শতাংশ পরিশোধ করতে হয়। অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল উভয়পক্ষের শুনানি শেষে রায় প্রদান করে শুল্ক নির্ধারণ করে দেন। অবশ্য, এই রায়ের বিরুদ্ধেও আবার উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এভাবে বছরের পর বছর হাজার হাজার কোটি টাকা শুল্ক আটকে রাখার সুযোগ রয়েছে। দেশের এক শ্রেণির অসাধু আমদানিকারক এভাবে কোটি কোটি টাকা আটকে রেখেছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিদ্যমান দুর্দিনে আটকে থাকা এসব রাজস্ব উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও সূত্রটি জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, ২২ হাজার ২৮২টি মামলায় আটকে থাকা ৩২ হাজার কোটি টাকার বিষয়টি নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিচার বিভাগের সাথেও আলাপ আলোচনা চলছে বলে উল্লেখ করে সূত্রটি জানায়, উচ্চ আদালতে বেঞ্চ বাড়িয়ে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। একই সাথে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পত্র দিয়ে বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তির তাগাদা দেয়া হবে।
এই ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আদালতে মামলা ঝুলে থাকায় আমাদের সংকটে পড়তে হচ্ছে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি বা এভাবে কথায় কথায় আদালতে যাওয়ার প্রবণতা ঠেকানো গেলে আটকে পড়া রাজস্ব আয় অনেক সহজ হয়ে যেতো। বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. ফখরুল আলম বলেন, উচ্চ আদালত, অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল এবং আপিল কমিশনারেটে চট্টগ্রাম কাস্টমসের রাজস্ব সংক্রান্ত ১০ হাজারের অধিক মামলা রয়েছে। মামলার জট কমানোর জন্য এনবিআর থেকে এডিআর (বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশনা আছে। আমরাও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। আমদানিকারকদের বুঝাচ্ছি। মামলার কারণে সরকারের রাজস্ব আদায় ব্যাহত হচ্ছে এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই।