নগরীতে প্রশংসাযোগ্য একটা কর্মযজ্ঞের উদ্বোধন হলো। চট্টগ্রাম মহসিন স্কুলের দেয়ালে চট্টগ্রামের ৩১ জন মনীষীর পোর্ট্রেট পরিচিতির উদ্বোধন হলো, যা নির্মিত হয়েছে এমএস প্লাজমা কাচ দিয়ে। এর শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘চট্টল গৌরব’। জামালখান ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের উদ্যোগে সহায়তা দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী। সাথে যুক্ত হয়েছে ফোর এইচ গ্রুপ।
‘সবুজে সাজবে নগরী, নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ হবে জামাল খান’ -এ স্লোগানকে উপলক্ষ করে কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের প্রথম প্রয়াস ছিল ডা. আবুল হাসেম চত্বরে দৃষ্টি নন্দন ফোয়ারার ব্যবস্থা। এরপর খাস্তগীর স্কুলের সীমানা প্রাচীরে টেরাকোটায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে বায়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পুরো ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ‘বরেণ্য বাঙালি’ শিরোনামে বিশ জন দেশবরেণ্য ব্যক্তির প্রতিকৃতি ও উদ্ধৃতি স্থান পেয়েছে সেন্ট মেরীস স্কুলের দেয়ালে। সেই ধারাবাহিকতায় ৩১ জন মনীষীর পোর্ট্রেট পরিচিতির উদ্বোধন হলো। যে ৩১ জনের ম্যূরাল উন্মোচিত হলো, তাঁরা হলেন, দানবীর হাজী মুহম্মদ মহসিন, মুহম্মদ এনামুল হক, আবুল কাশেম খান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মোজাফফর আহমদ, বিনোদ বিহারী চৌধুরী, কাজেম আলী মাস্টার, মাহবুব উল আলম, কল্পনা দত্ত, মাহাবুব উল আলম চৌধুরী, শেখ রফিউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী, শরৎ চন্দ্র দাস, বুলবুল চৌধুরী, চাকমা রাণী কালীন্দী, লোকনাথ বল, বেনীমাধব বড়ুয়া, আব্দুল হক দোভাষ, এম এ আজিজ, নবীনচন্দ্র সেন, অমলেন্দু বিশ্বাস, এম এ হান্নান, কবিয়াল রমেশ শীল, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, রজব আলী খান, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, নবীন চন্দ্র সেন, কবি আব্দুল হাকিম, আবদুল করিম, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, অধ্যাপক আবুল ফজল ও যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত।
আসলে চট্টগ্রামের রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত। আমরা জানি, ১৮৫৭ সালে হাবিলদার রজব আলী তার সহযোগীদের নিয়ে কারাগার আক্রমণ, অস্ত্রাগার ও কোষাগার লুণ্ঠন করে জানান দেন সিপাহী বিদ্রোহে চট্টগ্রামের অবস্থান। এরই ধারাবাহিকতায় গত শতকের প্রথমার্ধে চট্টগ্রামের মাটিতেই জ্বলতে থাকে বিপ্লবের আগুন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক সূর্যসেন ও তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রাণের বিনিময়ে এগিয়ে যায় মুক্তি সংগ্রাম। রক্তের সিঁড়ি বেয়ে একদিন ধরা দেয় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। মুক্তিসংগ্রামের দীর্ঘযাত্রায় চট্টগ্রামের ভূমিকা ও অবস্থান বরাবরই অগ্রপথিকের মতো।
ড. সালমা বিনতে শফিক তাঁর এক লেখায় বলেছেন, এককালে বাংলাকে বলা হত পৃথিবীর স্বর্গ আর চট্টগ্রাম ছিল সেই স্বর্গের প্রবেশদ্বার। পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, অরণ্য, খাল-বিল, হ্রদ, নদী, সাগর ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের কোলের কাছের সম্পদশালী এই জনপদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান প্রাচীন কাল হতেই নানা জাতিগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করত। তখন চট্টগ্রামের বড় একটা অংশ হরিকেল নামে পরিচিত ছিল। শিক্ষা, শিল্প, অর্থনীতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, এবং জ্ঞানচর্চায় হরিকেল রাজ্য প্রাচীন বাংলার একটি অগ্রগামী রাজ্য ছিল বলে জানা যায়। ‘কোমল মৃত্তিকার সমৃদ্ধ অর্থনীতির বাংলার’ সঙ্গে বাণিজ্য ছিল অতি লাভজনক। সে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল সুদূর পূর্ব ইউরোপে। আজ থেকে দু’হাজার বছর আগেই গ্রীক বণিকেরা চট্টগ্রামে বাণিজ্যতরী পাঠিয়েছিল।
ঐতিহ্যের এই চট্টগ্রামের ভাবমূর্তি কিছুটা ম্লান। চট্টগ্রামের হারানো গৌরবকে পুনরুদ্ধার করতে হলে কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের মতো উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তান, বিশেষ করে চট্টগ্রামের মনীষীদের কীর্তি ও কৃতিকে এভাবে উপস্থাপন করা গেলে ইতিহাস সচেতন প্রজন্ম তৈরি হতে পারে। জামালখান সেন্ট মেরীস স্কুলের দেয়ালে এবং মহসিন স্কুলের দেয়ালে যে ক’জন মনীষীকে উপস্থাপন করা হলো, তাঁদের পরে আরো নতুন মনীষাকে সংযুক্ত করা যেতে পারে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যে কয়েকটি প্রগতিশীল আন্দোলনে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে প্রয়াত মনীষীদের উপস্থাপন করা দরকার। এছাড়া সাহিত্য-সংস্কৃতি-সাংবাদিকতায় ভূমিকা পালনকারীদেরও মূল্যায়ন করতে পারলে কার্যক্রমটি আরো বেশি সার্থক হবে।
শৈবাল দাশ সুমনের এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর মতো অন্য কাউন্সিলররাও যদি যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসেন, তবে চট্টগ্রাম নান্দনিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে পরিণত হবে। আমরা সেই আশায় থাকলাম।