ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিস জনিত রোগে সারা বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে ১জন লোক মারা যায়। যার অর্থ বছরে প্রায় ৪ কোটি মানুষ মারা যায় এই ডায়াবেটিসের কারণে। এছাড়া ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ রোগীর পা কেটে ফেলার অন্যতম কারণও ডায়াবেটিস। ফলে রোগটি চিহ্নিত হয়েছে একটি নীরব ঘাতক ব্যাধি হিসেবে। আগে বয়স্করা ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হলেও বর্তমানে ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের শরীরে ডায়াবেটিস বেশি ধরা পড়ছে। বেশি বেশি ধূমপান, ক্রুটিযুক্ত খাদ্যাভাস ও শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণেই তরুণরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বব্যাপী এই রোগের ভীতিকর প্রভাবকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে জাতিসংঘ। যক্ষা ও এইচআইভি/এইডস সহ নানা সংক্রামক রোগের পাশাপাশি কোন অসংক্রামক ব্যাধিকে প্রথমবারের মতো বিশ্বজনীন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেটি হলো ডায়াবেটিস।
তবে আতংকের বিষয় প্রাপ্ত বয়স্ক প্রতি দুজন মানুষের একজন জানেনই না তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর পিছনে সচেতনতার অভাবকেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি খুবই ভয়ানক পরিস্থিতি বলে মনে করেন ডায়াবেটিস রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. শাহরিয়ার আহমেদ মিলন।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব হলে চিকিৎসায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়। কিন্তু শনাক্তই যদি না হয়, তবে ডায়াবেটিসের কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার মধ্যে চোখ, কিডনি ও হার্ট অন্যতম। আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে এই ডায়াবেটিস মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। তাই নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত এই ডায়াবেটিস থেকে বাঁচতে হলে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি বলছেন ডা. মিলন।
অন্যদিকে, প্রতি ৭ জন গর্ভবতী নারীর ১ জনের শরীরে ডায়বেটিস ধরা পড়ছে বলে জানালেন চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের সাবেক প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা হাসিনা আক্তার লিপি। উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটি গভীর আতংকের বিষয়। কারণ, নারীর গর্ভধারণের আগে বা গর্ভকালীন সময়ে সচরাচর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানো হয় না। গর্ভবতী নারীর শরীরে ডায়াবেটিস থাকলে গর্ভের শিশুটিও ডায়াবেটিসে আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে। অথচ, প্রাথমিকভাবে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কিন্তু ধরা না পড়লে মায়ের পাশাপাশি শিশুর যথেষ্ট ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই সচেতন হওয়ার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব শরীরে ডায়বেটিস রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আর আগে বয়স্করা ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হলেও বর্তমানে ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের শরীরে ডায়াবেটিস বেশি ধরা পড়ছে বলে জানান হাসিনা আক্তার লিপি। বেশি বেশি ধূমপান, ক্রুটিযুক্ত খাদ্যাভাস ও শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণেই তরুণরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বর্তমানে ৪২৫ মিলিয়ন (৪২ কোটিরও বেশি)। ২০৩০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের এ সংখ্যা দাড়াবে প্রায় ৫৫ কোটিতে। আর বাংলাদেশে বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। প্রতিবছর এ সংখ্যা বাড়ছেই। তবে শঙ্কার বিষয় হলো প্রতি দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন এখনও জানতে পারছেন না যে, তার ডায়াবেটিস রয়েছে।
এরই মাঝে আজ পালিত হচ্ছে জাতীয় ডায়াবেটিস সচেতনতা দিবস। ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ভাবে দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। এই দিনেই প্রতিষ্ঠা পায় বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি। দিবসটি উপলক্ষে চট্টগ্রামেও নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি।
ডায়াবেটিসের জন্য চট্টগ্রামের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল দীর্ঘ দিন ধরে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে আসছে। হাপাতালে প্রাপ্ত বয়স্ক (টাইপ–২) নিবন্ধিত (নিয়মিত চিকিৎসা সেবাগ্রহনকারী) রোগীর সংখ্যা বর্তমানে দুই লাখ ছাড়িয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া অপ্রাপ্ত বয়স্ক টাইপ–১ (১– ১৮বছর) রোগীর সংখ্যাও কয়েক হাজার। আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল শহরের বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি গ্রামে–গঞ্জেও শাখা স্থাপন করছে। এছাড়া খুলশীস্থ হাসপাতালে আউটডোর এবং ইনডোর দুই বিভাগেই সেবা প্রদান তো রয়েছেই।
খুলশীস্থ ডায়াবেটিক হাসপাতাল ছাড়াও নগরীর এনায়েত বাজার, বন্দর টিলা, কর্ণেলহাট মোস্তফা হাকিম ও অঙিজেন এলাকায় (মোট চারটি পয়েন্টে) সাব সেন্টার চালু করেছে ডায়াবেটিক সমিতি। চারটি সাব সেন্টারসহ নগরীর মোট ৫টি চিকিৎসা কেন্দ্রে আড়াই লাখেরও বেশি ডায়াবেটিস রোগী নিয়মিত চিকিৎসা নেন বলে ডায়াবেটিক হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস মূলতঃ একটি বিপাকজনিত রোগ। ইনসুলিন নামক হরমোনের অভাবে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। যা দেহে জটিলতা সৃষ্টি করে। এছাড়া, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, খাওয়া– দাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন, স্থুলতার পাশাপাশি বার্ধক্যও ডায়াবেটিসের কারন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। একারনে এই রোগের ব্যয়টাও একটু বেশী। ডায়াবেটিস প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিকার হিসেবে জীবন যাত্রার পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, ব্যায়াম ও ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বারোপ করে শুধু সচেতন হলে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করলে এ রোগ ৭০ ভাগ প্রতিরোধ সম্ভব বলেও জানান চিকিৎসকরা।
আর ডায়াবেটিস আক্রান্তের নেপথ্যে কায়িক পরিশ্রম না করা (যেমন সামান্য দূরত্বে রিকসা বা যানবাহন নেয়া), মোটা হওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে না রাখা, ফাস্ট ফুড খাওয়া ও কোমল পানীয় পান করাকেই অন্যতম কারণ হিসেবে বলছেন চিকিৎসকরা। এর জন্য সচেতনতা জরুরী জানিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন– সচেতনতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ না করলে রোগীর কিডনি, চোখ, হার্ট, যৌন দুর্বলতা, দাঁত, চামড়া, পা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে শারীরিক জটিলতার পাশাপাশি অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব বরণ করা ছাড়াও অকালে মৃত্যুবরণ করতে হতে পারে।
ডায়াবেটিস জটিলতার কারণে অনেক সময় পায়ে পচনশীল রোগ হয়ে পা কেটে ফেলার মতো ভয়ংকর অবস্থারও সৃষ্টি হতে পারে। তবে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় পাঁচটি নিয়ম মেনে চললে বেশ কিছু জটিলতা (অন্ধত্ব, হার্ট এটাক, কিডনি বিকল হওয়া এবং পঙ্গুত্ব) রোধ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন– খাদ্য ব্যবস্থা অর্থাৎ সুষম খাদ্য ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হওয়া, শরীরের ওজন আদর্শ ওজনে রাখা অর্থাৎ বি.এম.আই ২৫ এর মধ্যে রাখা, ডায়াবেটিস শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং ওষুধ–ইনসুলিন ও নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলা। এই নিয়মগুলো মেনে চললে ডায়াবেটিস রোগীদের বড় ধরণের জটিলতায় পড়ার আশঙ্কা কম বলে দাবি চিকিৎসকদের।