বাজেট শব্দটির সাথে আর্থিক ব্যবস্থাপনা জড়িত। অর্থনীতিতে বাজেট এর সংজ্ঞা দেয়া হয় এভাবে– নির্দিষ্ট সময়ে একটি অর্থনীতির সামগ্রিক আয় ও ব্যয়ের খতিয়ানকে বাজেট বলে। অবশ্য এ বাজেট হয় একটি রাষ্ট্রীয় বাজেট যা সাধারণত এক বৎসরের জন্য করা হয়। ব্যক্তি ক্ষেত্রেও বাজেট শব্দটি ব্যবহৃত হতে পারে। তবে ব্যক্তির বাজেটকে নিয়ে এত আলোচনার প্রয়োজন হয় না। সাধারণত রাষ্ট্রীয় বাজেটকে নিয়ে আলোচনা করা হয়। কারণ রাষ্ট্রীয় বাজেট রাষ্ট্রে বসবাসরত প্রত্যেক নাগরিকের ওপর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে আর্থিক বছর শুরু হয় জুলাই মাস থেকে। আর শেষ হয় পরবর্তী বৎসর জুনে। এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রের সামগ্রিক আয় এবং সামগ্রিক ব্যয়– এ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত থাকে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আয় আসবে কোন কোন খাত থেকে আর ব্যয় করা হবে কোন কোন খাতে–তার বিস্তারিত বিবরণ থাকে বাজেটে। বাজেটের প্রয়োগ যখন জুলাই মাস থেকে শুরু হয় তখন দেখা যায়, কোনো কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। কোন পণ্যের দাম হ্রাস পায় না। একটি পণ্যের দাম যখন বৃদ্ধি পায় তখন সমগ্র অর্থনীতিতে এর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি হচ্ছে এ রকম এক পড়ন্ত বিকালে শান্ত আবহাওয়ায় একটি পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলে দেখা যাবে পুকুরের পানি শান্ত এবং স্নিগ্ধ থাকে। আপনি যদি পুকুরের মাঝখানে একটি ঢিল ছোড়েন তবে দেখা যাবে ঢিলটি পুকুরের পানিতে পড়ার পর গোল আকৃতির একটি টেউ বৃত্তাকারে পুকুরের কিনারা পর্যন্ত চলে আসে। যদিও টেউটি ক্ষীণ থাকে ক্ষীণতর হয় তবুও পুকুরের কিনারায় এসে ঢেউটি ধাক্কা খায়। অর্থনীতির প্রতিক্রিয়াও সেরূপ। বাজেট প্রয়োগ হওয়ার পর যদি কোনো পণ্যের ওপর কর আরোপ করা হয় তবে উক্ত পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। আর এর প্রতিক্রিয়া সমগ্র অর্থনীতিতে ছড়িয়ে পড়বে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিস্কার হয়। মনে করি সরকার বাজেটে ইস্পাত শিল্পের উৎপাদনের উপর পঞ্চাশ শতাংশ হারে কর আরোপ করেছে। সরকারের আরোপিত কর উৎপাদনকারী কখনো বহন করবে না। আরোপিত করের পঞ্চাশ শতাংশ পণ্যের দামের ওপর অন্তর্ভুক্ত করবে উৎপাদনকারীরা। ফলে উৎপাদিত ইস্পাতের দাম পঞ্চাশ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। বাস্তবতায় আরো বেশি বৃদ্ধি পায়। বাজারে ইস্পাতের দাম যদি পঞ্চাশ শতাংশ বৃদ্ধি পায় তবে এর চাহিদা হ্রাস পাবে। দাম বৃদ্ধির কারণে ক্রেতারা ইস্পাতের ব্যবহার কমিয়ে দেবে। ব্যক্তি বিশেষ বিল্ডিং, দালান কোটা তুলতে চাইবে না। ডেভেলপার কোম্পানীগুলো ফ্ল্যাটের দাম বাড়িয়ে দেবে। অথবা তারা নতুন নতুন বিল্ডিং তুলতে আগ্রহী হবে না। ফলে নির্মাণ শিল্পের সাথে নিয়োজিত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। তাদের আয় কমে যাবে। এ কারণে অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদাও কমে যাবে। অর্থাৎ শ্রমিকেরা বেকার হওয়ার কারণে নিজ নিজ প্রয়োজনীয় পণ্য তারা ক্রয় করতে পারবে না। এসব পণ্যের উৎপাদকেরা পণ্য উৎপাদন কমিয়ে দেবে। সেই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিল্পের মূল্য সংকোচন দেখা দেবে। অর্থাৎ একটি পণ্যের ওপর কর আরোপ করার কারণে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে এর প্রভাব পড়েছে। এজন্য বাজেট প্রয়োগ হওয়ার পর থেকে অর্থনীতিতে অনেক প্রকারের সংকট দেখা দিতে পারে।
২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। যেহেতু বাজেটে আয় ও ব্যয়ের দুইটি দিক আছে সেহেতু বলা যায়, আয়ের লক্ষ্যমাত্রা যেমন আছে তেমনি ব্যয়ের খাতগুলোও আছে। এই খাতগুলো কী? অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকার বাজেটে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআর (NATIONAL BOARD OF REVENUE) বাজেটের আয় হিসেবে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর রাজস্ব বহির্ভূত আয় নির্ধারণ করেছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এতো গেল আয়ের খাত। ব্যয়ের খাতে রয়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) তে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ ও সারের ভর্তুকি বাবদ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। সুদ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। আর বেতন–ভাতা বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকা। তাছাড়া অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশ, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.২৫ শতাংশ এবং ঘাটতি জিডিপি ৪.২৫ শতাংশ।
যদি পরিসংখ্যানগতভাবে দুইটি সময়ের মধ্যে বেকারত্বের হার, রাজস্ব আদায়, জিডিপি এর প্রবৃদ্ধি এবং জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগকে তুলনা করা যায় তবে জানা যাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাব্য সংকটের পরিমাণ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বেকারত্বের পরিমাণ ছিল ২৫.৫০ লাখ। আর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে তা ছিল ২৭ লাখ। বাংলাদেশ ব্যাংক, বিবিএস (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো) থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে জিডিপি (GROSS DOMESTIC PRODUCT) এর প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৪.২২ শতাংশ। আর ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলিত হার হচ্ছে ৩.৯৭ শতাংশ। উক্ত সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ হয়, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ২৩.৯৬ শতাংশ। আর ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রাক্কলিত জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি বিনিয়োগ হয় ২২.৪৮ শতাংশ। আর রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে ও জুলাই এপ্রিল ২০২৫ এর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩.৫৮ লাখ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে আদায় হয়েছে ২.৮৯ লাখ কোটি টাকা । যদিও রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে, প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা সুখবর রয়েছে।
অর্থনীতির দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে মোট বিনিয়োগ ও মোট দেশজ সঞ্চয়। সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে যে, এ দু’টোই কমে গেছে। এবার মোট বিনিয়োগের হার হচ্ছে জিডিপির ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। পূর্বে এর তুলনায় কম বিনিয়োগের অর্থবছর ছিল ২০১৩–১৪। এ সময়ে ছিল জিডিপির ২৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ আর মোট দেশজ সঞ্চয় কমছে তো ধারাবাহিকভাবে। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি দেশে মোট দেশজ সঞ্চয় কমে যাওয়া একটি সম্ভাব্য সংকটের লক্ষণ। কারণ এর প্রভাব বহুমাত্রিক। এর অর্থ হচ্ছে অর্থনীতির ব্যক্তিবর্গরা এবং প্রতিষ্ঠানগুলো যা আয় করছে তার বেশির ভাগই খরচ করে ফেলছে। ফলে সঞ্চয় হচ্ছে না। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষ খরচ বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। এমন কি পূর্বে সঞ্চিত অর্থ ভেঙে ফেলে জীবনযাত্রা নির্বাহ করছে। অন্যদিকে আর্থিক খাতে অনিশ্চয়তার কারণে মানুষ ব্যাংকেও অর্থ কম রাখছে। বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করার জন্য ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। অথচ ব্যাংকখাত থেকে ব্যক্তি ঋণ নিচ্ছে কম। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগও কম। অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগও আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অনুপাতে কর্মসংস্থানের হার প্রায় ২ শতাংশ কমে গেছে। কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে সবখাতে। সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে সেবা খাতে যা ২.৬ শতাংশ। এরপর রয়েছে কৃষিখাত। এ খাতে হ্রাস পেয়েছে ২.৩ শতাংশ। আর শিল্পখাতে হ্রাস পেয়েছে ০.৮ শতাংশ। এর ফলে দেশে বেকারত্ব বেড়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, উচ্চমূল্যস্ফীতি ও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় এবার অতিরিক্ত ৩০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে চলে যেতে পারে। এর উপর রয়ে গেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সবগুলো মিলিয়ে ২০২৫–২৬ সালের বাজেট হচ্ছে অর্থনীতিকে ধরে রাখার এক নিদারুণ প্রচেষ্টার বাজেট। তবে এ দেশের জনগণের সার্বিক সহযোগিতা ও সরকারের সুষ্ঠ আর্থিক নীতিই পারে এ সংকট থেকে উদ্ধার করতে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।