১৯৭১ সালের এক সকাল। চারদিকে তখন বারুদের গন্ধ আর মানুষের আর্তনাদ। এই বিভীষিকাময় সময়ে ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল গ্রামের এক কিশোরী টেপরি বর্মনের জীবনও থমকে গিয়েছিল। টানা টানা চোখের এই মেয়েটি ছিল অসম্ভব রূপবতী। তার রূপের খ্যাতি কেবল গ্রামেই সীমাবদ্ধ ছিল না, আশেপাশের গ্রামের মানুষও তার সৌন্দর্যের কথা জানত। বাবা আর দুই ভাইয়ের চোখের মণি ছিল টেপরি। তারা টেপরিকে নিয়ে গর্ব করত। তাদের কাছে টেপরি কেবল এক সুন্দর মেয়ে ছিল না, ছিল তাদের স্বপ্ন, তাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
টেপরির বয়স তখন ১৬–১৭ এর মত হবে। প্রতিদিন বাবা ভাইয়ের সাথে ভয়ে ভয়ে কাটে তাদের দিন। প্রতিদিনই মনে হয় এই বুঝি পাঞ্জাবিরা এসে তাদের মেরে ফেলবে। এপ্রিলের শেষদিকে টেপরির গ্রামের এক নেতৃস্থানীয় লোক তার বাবা ভাইকে বলে “যদি তোমরা তোমাদের এই মেয়েটাকে পাকিস্তানের ক্যাম্পে পাঠাই দাও তাইলে এই মেয়ের উছিলায় তোমার পুরা পরিবার বেঁচে যেতে পার”।
কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছিল একাত্তরের কালো থাবায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন গ্রামে প্রবেশ করে, তখন টেপরির বাবা আর ভাইয়েরা তাকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু শত্রুদের নির্মমতার কাছে তাদের প্রতিরোধ ছিল বড্ড অসহায়। টেপরির চোখের সামনেই তার বাবা ও ভাইদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। টেপরি তাদের রক্ষা করতে চেয়েছিল, কিন্তু শত্রুদের হিংস্রতা তাকে পরাস্ত করে।
টেপরির রূপই যেন তার জন্য অভিশাপ হয়ে এসেছিল। নরপশুদের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছিল তার ওপর। তারা টেপরিকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। গ্রামের পর গ্রাম খুঁজেও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। গ্রামের মানুষের মনে হয়েছিল, টেপরি হয়তো আর বেঁচে নেই।
বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কিন্তু টেপরি বেঁচে ছিলেন। পাকবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর, তিনি তাদের ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন। তিনি শুধু নিজের জীবন নিয়েই ফিরে আসেননি, সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের এক নিদারুণ ফল। গর্ভে ধারণ করেছিলেন তাদেরই সন্তান।
যুদ্ধ শেষ হলে টেপরি কোনোভাবে নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। কিন্তু স্বাধীনতার আলোয় ঝলমল করা গ্রামটিতে তার জন্য অপেক্ষা করছিল এক ভিন্ন ধরনের যুদ্ধ। সমাজের কটু কথা, তিরস্কার, আর ঘৃণার তির তাকে বিঁধতে থাকে। একাত্তরের সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার চেয়েও বেশি কষ্টকর ছিল সমাজের এই নির্মমতা।
টেপরির বাবা তাকে বলে রেখে দে মা, তোর তো আর কেউ হবে না এই বাচ্চাই তোর সম্বল হবে। শেষ বয়েসে তোর সম্বল হবে এই বাচ্চা। টেপরি বাবার কথা শুনেছিল। তার গর্ভে বেড়ে ওঠা এই সন্তানকে তিনি ভালোবাসার সঙ্গে লালন–পালন করতে শুরু করেন। কারণ এই শিশু তার কাছে ছিল জীবনের প্রতীক, বেঁচে থাকার এক নতুন প্রেরণা।
জন্ম হয় টেপরির ছেলে। ছেলের নাম রাখা হয় সুধীর বর্মন।
ছোট থেকেই সুধীরের সাথে কেউ খেলতো না, তার থেকে সবাই দূরে দূরে থাকতো। এমন যে সুধীর মনে হয় কোন ছোঁয়াছে রোগ। তাকে সবসময় জারজ বাচ্চা বলে ডাকতো, আর অনেক অপমান করতো। কিন্তু সুধীর কিছুই বলতো না।
কেন কোন প্রতিবাদ করতো না সুধীরকে একবার প্রশ্ন করায় সুধীর বলেছিল “ঝগড়া করতে তো লোক লাগে, কিন্তু আমার কে আছে?” জীবনটা তার ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এভাবেই এক একাকী ভ্যানচালক সুধীরের জীবন কাটে।
টেপরি বর্মন তাই শুধু রানীশংকৈলের এক কিশোরী নয়, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক নীরব সাক্ষী, যিনি যুদ্ধের নৃশংসতা থেকে বেঁচে ফিরেও প্রতিদিন এক নতুন সংগ্রামের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁর গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, যুদ্ধ শুধু অস্ত্র আর রক্তের খেলা নয়, এটি মানব হৃদয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এক গভীর ক্ষত, যা সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। টেপরির মতো হাজারো নারী সেই ক্ষত বয়ে বেঁচে ছিলেন, এবং তাদের সাহস আর দৃঢ়তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবময় অধ্যায়।