ঘটনা আঁচ করতে পেরেছেন আগেই। সুবিধাভোগী ঊর্ধ্বতন মহল তাকে সতর্ক করায় বছর দেড়েক আগে তিনি টেকনাফ বন্দর ছাড়েন। তবে তার স্থলে বসান আপন ভায়রাভাইয়ের ছেলে আহমেদ রানাকে। মূলত রানা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে টেকনাফ বন্দরে এখন রাজত্ব করছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। অবশেষে ধরা পড়লেন নুরুল ইসলাম (৪১)। টেকনাফ স্থলবন্দরে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে দিনে ১৩০ টাকা বেতনে চাকরি করতেন নুরুল ইসলাম। এই চাকরিকে পুঁজি করে তিনি ২০ বছরে অবৈধভাবে প্রায় ৪৬০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে র্যাব। গত সোমবার মধ্যরাতে তাকে বাংলাদেশি জাল নোট, মিয়ানমারের মুদ্রা ও ইয়াবাসহ রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব কর্মকর্তারা এ তথ্য জানান।
জানা যায়, ২০০১ সালে টেকনাফ স্থলবন্দরে চুক্তিভিত্তিক দৈনিক ১৩০ টাকা বেতনে চাকরি নেন তিনি। র্যাব জানায়, চিহ্নিত ১০-১৫ জন সদস্যকে নিয়ে নুরুল পণ্য খালাস, পরিবহন সিরিয়াল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পথিমধ্যে অবৈধ মালামাল খালাসে সক্রিয় থাকত। একই সাথে পার্শ্ববর্তী দেশ হতে কাঠ, শুটকি মাছ, বরইয়ের আচার, মাছের চালান রপ্তানির আড়ালে মাদকসহ অবৈধ পণ্য নিয়ে আসত। টেকনাফ বন্দর, ট্রাক স্ট্যান্ড, বন্দরের শ্রমিকদের ও জাহাজের আগমন-বহির্গমনও নুরুলের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করত। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে উপার্জিত কোটি কোটি টাকা হালাল করতে এমএস আল নাহিয়ান এন্টারপ্রাইজ, এমএস মিফতাউল এন্টারপ্রাইজ, এমএস আলকা এন্টারপ্রাইজ, আলকা রিয়েল স্টেট লিমিটেড এবং এমএস কানিজ এন্টারপ্রাইজ নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নুরুল।
প্রাথমিকভাবে ঢাকা শহরে তার ছয়টি বাড়ি ও ১৩টি প্লট ছাড়াও সাভার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, ভোলাসহ বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে ৩৭টি বাড়ি, খোলা জায়গা-প্লট ও বাগানবাড়ি এবং ১৯টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকার তথ্য মিলেছে।
অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের আনুমানিক মূল্য ৪৬০ কোটি টাকা জানিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, নুরুল এখন জাহাজ শিল্প ও ঢাকার কাছে একটি বিনোদন পার্কে বিনিয়োগ করছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও তদন্তের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
র্যাব জানায়, নুরুল বন্দরে কর্মরত থাকাকালীন তার অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে চোরাকারবার, শুল্ক ফাঁকি, অবৈধ পণ্য খালাস ও দালালির কৌশল রপ্ত করে। প্রায় ৮ বছর পর চাকরি ছেড়ে নিজেই দালালির সিন্ডিকেট তৈরি করেন। এদিকে নুরুল ইসলাম আটক হওয়ায় টেকনাফ স্থলবন্দর কেন্দ্রিক তার গড়া সিন্ডিকেটে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আহমেদ রানাকে তার স্থলে বসিয়ে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড দেখভাল ও অপর ছেলে নুরুল কায়েস সাদ্দামকে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেন নুরুল ইসলাম। দেড় বছর ধরে এ দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে ১০/১২ জনের সিন্ডিকেট টেকনাফ বন্দরে এবং নুরুল ইসলাম ঢাকাকেন্দ্রিক অবৈধ-বৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, নুরুল ইসলাম টেকনাফ বন্দরে এমন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন যে, তার কথায় কাস্টমস কর্মকর্তারা উঠবস করতেন।
জানা যায়, নুুরুল ইসলাম চাকরি নিয়ে টেকনাফ পৌর এলাকার শুল্ক গুদাম কর্মকর্তার কার্যালয়ে রাত্রিযাপন করতেন। সেই সুবাদে পাশের বাড়ির এক মেয়েকে বিয়ে করেন। আত্মীয়তার সুযোগে এলাকার ব্যবসায়ীদের সাথে সম্পর্ক গড়েন। ধীরে ধীরে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও আস্থাশীল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। টেকনাফ বন্দরে সব কর্মকাণ্ডের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেন।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর থেকে প্রভাব কমতে শুরু করে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি নুরুল পরিবারসহ ঢাকায় চলে যান। এ সময় রানা-সাদ্দাম সিন্ডিকেট টেকনাফ বন্দরে রাজত্ব কায়েম করে। তারা স্থলে কম্পিউটার অপারেট করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন আহমেদ রানা।
তবে টেকনাফ বন্দরের শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তা আব্দুল নূর এসব বিষয় অস্বীকার করে বলেন, একসময় নুরুল ইসলাম সবকিছু দেখভাল করত বলে শুনেছি। কিন্ত আমি আসার পর তাকে পাইনি। তাছাড়া বর্তমানে এখানে মাস্টার রোলে কেউ চাকরি করছে না।
বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে রানা বহাল তবিয়তে আছেন। সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করলে তা ধরা পড়বে। একটি সূত্র বলছে, রানা-সাদ্দাম সিন্ডিকেট গত কয়েক বছরে একাধিক বহুতল ভবন, গাড়ি ও জায়গার মালিক হয়েছেন। এ বিষয়ে কথা বলতে আহমেদ রানার মোবাইলে কল করলেও তাকে পাওয়া যায়নি।












