নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ১১ হাজার ব্যয়ে চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম তদারকি করতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে। সিটি মেয়র ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এই কমিটির উপদেষ্টা। কমিটি সকল সেবা সংস্থার সাথে সমন্বয় করবে এবং প্রতি মাসে প্রকল্পের কার্যক্রম ও অগ্রগতি পর্যালোচনায় সভা করবে। একই সঙ্গে প্রকল্পের ডিজাইনে কোনো ত্রুটি আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখবে। নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন এবং কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি, দখল, দূষণ রোধে গৃহীত কার্যক্রম পর্যালোচনার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় এ কমিটি গঠন করা হয়। গতকাল শনিবার সকালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম।
বিভাগীয় কমিশনার কামরুল হাসানের সভাপতিত্বে সভায় সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, স্থানীর সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কবির বিন আনোয়ার, সিডিএ চেয়ারম্যান এম জহিরুল আলম দোভাষ, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম এ সালাম, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক একে এম ফজলুল্লাহ বক্তব্য রাখেন।
কমিটি গঠন প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনসহ সুন্দর নগর নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন। প্রকল্পগুলো যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং বাস্তবায়নকালে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে তার সমাধানে কমিটি করা হয়েছে। কমিটি প্রতি মাসে সভা করে প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করবে এবং চট্টগ্রামকে একটি দৃষ্টিনন্দন শহরে রূপান্তর করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর যে আকাঙ্ক্ষা তা পূরণে কাজ করবে।
কমিটির আকার প্রসঙ্গে বলেন, সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি। স্বাভাবিকভাবে জেলা প্রশাসক থাকবেন। অন্য স্টেক হোল্ডারদের উনারা ঠিক করে নেবেন। উল্লেখ্য, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি নিয়ে গত ১৬ জুন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের উদ্যোগেও একটি সভা হয়েছিল। ওই সভায় বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে একটি কমিটি করা হয়েছিল প্রকল্পে সমন্বয় সাধন ও মনিটরিং করার লক্ষ্যে।
ডিজাইনের ত্রুটি খতিয়ে দেখাসহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো : নগরের বিভিন্ন খালের মুখে নির্মাণাধীন স্লুইচগেটের প্রশস্ততা এবং রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণের কারণে কোথাও কোথাও খাল সংকুচিত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী। এক্ষেত্রে ডিজাইনের কোনো ক্রটি আছে কিনা জানতে চান তিনি। তখন সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কর্মকর্তা জানান, ডিজাইনে ত্রুটি নাই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিজাইন সেল থেকে স্লুইচগেটের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। এরপরও মন্ত্রী ডিজাইন আরো খতিয়ে দেখতে নির্দেশনা দেন। এক্ষেত্রে পাউবোর ডিজাইন সেলের সঙ্গে বসে কোনো ত্রুটি পেলে ডিজাইন রিভিউ করা এবং প্রয়োজনে প্রকল্পের রিভাইস ডিজাইন ডিপিপিতে পুনরায় অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত দেন।
প্রকল্পের ডিজাইনের বাইরে সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী প্রল্পের সুফল নিশ্চিতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত দেন। সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) কর্তৃক শহরের ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ডেভেলপ করা এবং বিভিন্ন খালে মানুষের ময়লা ফেলার যে প্রবণতা তা বন্ধ করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া। দ্রুত সিডিএর মেগা প্রকল্পের আরডিপিপি করে ভূমি অধিগ্রহণ শুরু করা। এছাড়া পাউবোর চলমান প্রকল্পে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সৃষ্ঠ জটিলতা বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান।
অগ্রগতি : সভায় জানানো হয়, ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক সিডিএর মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেনাবাহিনী। প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৫৫ শতাংশ। ১ হাজার ৬২০ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গত ২৫ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। ২ হাজার ৩১০ কোটি ২৪ লাখ ২০ টাকার প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৪৯ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এছাড়া ১ হাজার ৩৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরের বহদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খননে চসিকের একটি প্রকল্প আছে। প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭৩ শতাংশ। ভৌত অগ্রগতি নেই।
মন্ত্রী যা বললেন : সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রকল্পের ডিজাইনের ত্রুটি প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ডিজাইনগুলো যেভাবে করা হয়েছে সেখানে কোনো ত্রুটি আছে কিনা সেটা যাচাই করবে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি। তারা ডকুমেন্টারি দেখে বিচার-বিশ্লেষণ করবে। কোনো ত্রুটি পেলে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে। এর ভিত্তিতে সংশোধন করা হবে।
কোনো ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সায়েন্টিফিক অ্যানালাইসিস করে দেখতে হবে। ‘আপ স্ট্রিম’ থেকে কী পরিমাণ পানি আসছে, যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে সেটা দিয়ে কতটুকু ‘আউট ফ্লু’ হতে পারে তা হিসাব করে বলা যাবে।
কবে নাগাদ চট্টগ্রামবাসী জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাংলাদেশ হিমালয়ের পাদদেশের একটি দেশ। এখানে পলি জমবে। অতি মাত্রায় বৃষ্টি হলে পানির প্রবাহও বাড়ে। ফলে এখানে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। জলাবদ্ধতা থাকবে। এটা যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে এ জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
কর্ণফুলীর ড্রেজিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদী দূষণমুক্ত এবং নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রকল্প নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এখানে টেকনিক্যাল কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তলদেশে অনেক পলিথিন জমা আছে। সেজন্য স্কেভেটর ঠিকভাবে কাজ করছিল না। এখন আরো আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে কাজটা শুরু করা হয়েছে। এতে ফলাফল ভালো পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, কর্ণফুলীর ড্রাফট সঠিকভাবে মেইনটেইন করা না গেলে প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে জাহাজ বন্দরে ঢুকতে পারবে না। এজন্য বিভিন্ন সময়ে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
এর আগে সভার শুরুতে তিনি বলেন, কর্ণফুলীতে ২০ ফুট পলি জমেছে। কিন্তু সেটা কেন হবে? এখানে তো ১০ বছর পর পর ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার কথা ছিল। হলে তো তলানিতে এত পলি জমত না। তিনি বলেন, পলিথিনের স্তর জমেছে কর্ণফুলীতে। যারা দায়ী তাদের চিহ্নিত করা বা শাস্তি দেওয়ার জন্য বসে থাকলে তো হবে না। এটা তো পরিষ্কার করতে হবে।
তিনি বলেন, কর্ণফুলীর দুই পাড়ে শিল্পকারখানা হয়েছে। সেখানে ইটিপি বসানো হয়নি। তরল বর্জ্য নদীতে পড়ছে। দূষণ বাড়ছে। সলিড ওয়েস্ট নদীতে ফেলছে। নদীর ড্রাফট কমে যাচ্ছে। এসব বিষয়কে আমলে নিতে হবে। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর তাদের জায়গা কাউকে লিজ দিতেই পারে। কিন্তু শিল্প কারখানা করার জন্য বন্দরের আশেপাশে তো দেওয়া যাবে না। সমস্ত জায়গা শিল্প কারখানা করার জন্য দিয়ে নদীর মনোরম সৌন্দর্য নষ্ট করা, ড্রাফট কমানোর অধিকার আপনাদের কেউ দেয়নি। বিত্তবান মানুষরা চাইতেই পারে। কিন্তু যারা অথরিটি তারা কী করছে। এ সময় তিনি বলেন, এখানে বন্দরের চেয়ারম্যান আছেন। আপনাকে শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরকে ভালোবাসতে হবে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে নগর পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর পাড় লিজ দিয়ে কোনো ধরনের কল-কারখানা নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না। চট্টগ্রামকে দেশের অর্থনীতির প্রাণ উল্লেখ করে তিনি জানান, এ শহরকে নিয়ে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই।
তাজুল ইাসলাম বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু জায়গায় অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে বা হচ্ছে। সেসব অবকাঠামো সঠিকভাবে না হলে দুর্ভোগ বয়ে আনবে। তিনি বলেন, কিছু অবকাঠামো হয়েছে, যেগুলোর নকশা যদি ঠিক হতো, ট্রাফিক প্রবলেম সলিউশন করার জন্য যে ডিমান্ড তা ঠিকভাবে হতো। তাহলে সমস্যারও সমাধান হতো। কিন্তু না হওয়ায় উল্টো সমস্যা হয়েছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম শহরের ভেতর অনেকগুলো খাল আছে, যেগুলো দিয়ে এক সময় নৌকা চলাচল করত। খালের সুপেয় পানিও মানুষ ব্যবহার করতেন। সময়ের ব্যবধানে এসব খালের অংশবিশেষ দখল হয়ে গেছে। সিলট্রেশন হয়েছে। খালগুলো সংরক্ষণ ও সংস্কার কাজ ঠিকভাবে না করার কারণে এ সমস্যা হয়েছে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে ভোগ বেড়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবে বর্জ্যও বাড়বে। সেসব বর্জ্য বিভিন্নভাবে খালা-নালায় পড়ছে এবং ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এগুলোকে মোকাবিলা করতে হবে।
চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় পাহাড় রক্ষার উপর জোর নজর দিতে হবে। সেবা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের উদ্দেশে বলেন, অহেতুক কেউ কারোর ওপর দোষারোপ করার মাধ্যমে সরকারের অর্জন ম্লান করার অধিকার কারো নেই। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়নে যথেষ্ট আন্তরিক।