কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল রোববার বেলা ১টার দিকে তাকে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানিয়েছেন মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার হারুন অর রশিদ। মামুনুল এই মাদ্রাসার শিক্ষক।
তিনি বলেন, ২০২০ সালে মোহাম্মদপুর থানার একটি নাশকতা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হেফাজতের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা, থানায় হামলা, রেজিস্ট্রার অফিসে হামলা, ভাঙচুরসহ অনেকগুলো মামলা রয়েছে। এসব মামলার তদন্ত চলছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে তাকে নজরদারিতে রেখেছিলাম, পাশাপাশি ২০২০ সালে মোহাম্মদপুর থানার একটি ভাঙচুর-নাশকতার মামলা তদন্ত করছিলাম। তদন্তে সেই ঘটনায় সুস্পষ্ট সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। খবর বিডিনিউজ, বাংলানিউজ ও বিবিসি বাংলার।
এদিকে মামুনুল হকের সাত দিনের রিমান্ড চাইবে পুলিশ। আজ সোমবার তাকে আদালতে পাঠিয়ে এ রিমান্ড চাইবে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ। ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, তাকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। মোহাম্মদপুর থানায় দায়েরকৃত নাশকতার একটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ মামলায় সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে আদালতে পাঠানো হবে। রিমান্ডে এনে আরো ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে নানা বিষয়ে আরো তথ্য পাওয়া যাবে।
উপ-কমিশনার হারুন বলেন, মোহাম্মদপুর থানার মামলা ছাড়াও গাজীপুরের মো. শাজহান নামের একজন তার বোনকে মামুনুল যে বিয়ে করার পর থেকে তাকে না পাওয়ার ব্যাপারে মোহাম্মদপুর থানায় যে জিডি করেছে, সে বিষয়েও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
গত বছরের নভেম্বরে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে আলোচনায় আসেন মামুনুল হক। এরপর ভাস্কর্যের নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ডিসেম্বরে কুষ্টিয়া শহরে জাতির পিতার একটি নির্মাণাধীন ভাস্কর্যের ভাঙচুর চালানো হয়। ভাস্কর্য বিরোধিতা এবং ভাঙচুরের ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে।
এ বছর মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের বিরোধিতায় ঢাকা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালায় হেফাজত। এর মধ্যে সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে ঢাকায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকায় সংঘাত-নাশকতার ঘটনায় মামুনুল হকসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।
এরপর গত ৩ এপ্রিল সোনারগাঁওয়ের একটি রিসোর্টে এক নারীসহ আটক হয়ে আবারও আলোচনায় আসেন হেফাজতের এই নেতা, যাকে তিনি নিজের দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করেছেন। এরপর থেকে সংগঠনটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
যেভাবে গ্রেপ্তার : পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে রিসোর্টকাণ্ডের পর থেকেই মোহাম্মদপুরের জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় অবস্থান করছিলেন মামুনুল হক। সেই সময় থেকেই পুলিশ তার ওপর নজর রাখছিল।
গতকাল দুপুরে গোয়েন্দা পুলিশ ও তেজগাঁও বিভাগের শতাধিক পুলিশ ওই মাদ্রাসাটা ঘিরে ফেলে। মাদ্রাসার দোতলার একটি কক্ষ থেকে মামুনুল হককে নিয়ে একটি মাইক্রোবাসে তোলা হয়। এরপর প্রথমে তাকে তেজগাঁও ডিভিশনের ডিসির কার্যালয়ে নেওয়া হয়। পরে তাকে মিন্টো রোডে ডিবি পুলিশের কার্যালয়ে নেওয়া হয়।
হেফাজতে ইসলামের প্রতিক্রিয়া : মামুনুল হক গ্রেপ্তার হওয়ার পর হেফাজতে ইসলামের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংগঠনটির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো মোকাবেলার জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি আইনি প্যানেল তৈরি করা হয়েছে। মামলাগুলোকে সংগঠনের পক্ষ থেকে আইনিভাবে মোকাবেলা করা হবে। তিনি আরো বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে দলের সিনিয়ররা বসেছেন, কথা বলছেন। কথা বলে পরবর্তী পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত নেবেন।
বাকি দুই বিয়ের কথা স্বীকার : সোনারগাঁওয়ে রিসোর্টকাণ্ডের পর মামুনুলের কথিত আরো দুই স্ত্রীর বিষয়টি আলোচনায় আসে। গ্রেপ্তারের পর পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই দুই নারীকে বিয়ে করেছেন বলে স্বীকার করেছেন তিনি। তবে প্রমাণের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
গত ১০ তারিখ মোহাম্মদপুর থানায় জান্নাতুল ফেরদৌস ওরফে লিপি নামে এক নারীর সন্ধান চেয়ে জিডি করেন তার ভাই শাহজাহান। জিডিতে লিপি নামে ওই নারীকে মামুনুলের স্ত্রী বলে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে মামুনুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি জানান, লিপি নামে ওই নারীকেও তিনি বিয়ে করেছেন। অর্থাৎ লিপি তার তৃতীয় স্ত্রী। জিজ্ঞাসাবাদে ‘বিয়ে করেছেন তো পরিবার ওই নারীর সন্ধান পাবে না কেন? বিয়ে তো পাপ নয়’, এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
মামুনুলের সঙ্গে সোনারগাঁয়ের এক রিসোর্টে আটক নারীর বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই নারীকেও স্ত্রী বলে দাবি করেছেন তিনি। তাহলে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে অন্য কারো স্ত্রী হিসেবে পরিচয় করানোর কারণ জানতে চাইলে কোনো জবাব দেননি মামুনুল। এদিকে, তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় অজস্র মামলা রয়েছে জানিয়ে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, পর্যায়ক্রমে মামুনুলকে সেসব মামলাতেও শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হবে।
দেশজুড়ে সতর্ক অবস্থানে পুলিশ : বহু আলোচনা-সমালোচনার পর অবশেষে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মামুনুল হককে। তার গ্রেপ্তার ঘিরে যেকোনো ধরনের অপতৎপরতা এড়াতে দেশজুড়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, হেফাজতে ইসলামের দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও তাণ্ডবের পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে যায়। বিভিন্ন থানায় বাংকার বানিয়ে এলএমজি গার্ড বসানো হয়। কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন সহিংসতায় জড়িতরাসহ গ্রেপ্তার করা হয় নির্দেশদাতা হিসেবে কেন্দ্রীয় নেতাদের।
এদিকে গতকাল মামুনুলকে গ্রেপ্তারের পর সারা দেশে বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ হেফাজত অধ্যুষিত এলাকায় বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করে সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গতকাল সকালে সব এসপি ও রেঞ্জের ডিআইজিকে নিজ নিজ জেলার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সতর্ক অবস্থানে থাকতে বলা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে সেই নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কেউ যাতে কোনোভাবে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছে। অপতৎপরতাকারীদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব থানায় বাংকার তৈরি করা হয়েছে, সেখানে সার্বক্ষণিক দুজন পুলিশ সদস্যকে অন-গার্ড দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছে।
ডিএমপির একজন কর্মকর্তা জানান, থানাগুলোতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া যেসব থানা এলাকার মাদ্রাসা ও মসজিদ রয়েছে সেসব কেন্দ্রিক বাড়তি নজরদারি রয়েছে। মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোতে যাতে কেউ জড়ো হতে না পারে সে বিষয়ে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর সরকার : ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশের পর থেকে সংগঠনটির সঙ্গে সরকারের এক ধরনের সহাবস্থান থাকলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফর ঘিরে সহিংসতা আর মামুনুল হকের রিসোর্ট কাণ্ডের পর থেকে কঠোর অবস্থান নিতে শুরু করে সরকার। এর মধ্যে সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর হেফাজত সভাপতি মোহাম্মদ জুনায়েদ আল হাবীব এবং সহকারী মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা মহানগরীর ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলানা জুবায়ের আহমেদসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কয়েকজনকে ২০১৩ সালে হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।