কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘সহজ সংস্কার পশুদের, বুদ্ধি মানুষের। সহজ সংস্কারের গম্যস্থান সামান্য সীমার মধ্যে বুদ্ধির শেষ লক্ষ্য এই পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই।’
এখন হয়ত তা আবিষ্কারের পথে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই সম্ভবত সেই আবিষ্কার। হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এবং ‘সুখী হৃৎপিণ্ড, সুস্থ হৃৎপিণ্ড’ এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে গত ৭ থেকে ১০ ডিসেম্বর কলকাতার আইসিটি সোনার বাংলা হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় কার্ডিওলজিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া (সিএসআই) প্রতিষ্ঠার ৭৭ বছর উদ্যাপনে প্লাটিনাম জুবিলি অনুষ্ঠান। ১৯৪৬ সালে বিশ্বখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক ও পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ভারতরত্ন ডা. বিধান চন্দ্র রায় হৃদরোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধে কলকাতায় সিএসআই প্রতিষ্ঠা করেন। উল্লেখ্য সেই সময়ে হৃদরোগের প্রকোপ বর্তমান সময়ের মতো এতটা ব্যাপক ছিল না। বর্তমানে হৃদরোগ ভারত উপমহাদেশ সহ সারা বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণ হলেও সেই সময়ে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধিই ছিল মৃত্যুর প্রধান কারণ। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. বিধান চন্দ্র রায় অনুধাবন করছিলেন কাল পরিক্রমায় ভবিষ্যতে হৃদরোগই এতদ্ অঞ্চলে মানুষের ভোগান্তি ও মৃত্যুর প্রধান কারণ হতে যাচ্ছে। তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সিএসআই নামক এই প্রতিষ্ঠান।
সদ্য সমাপ্ত সিএসআই কনফারেন্স ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাঁচ হাজারের বেশি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ফ্যাকালটি হিসাবে ছিলেন ৫০০ জন ভারতীয় এবং ৪৪ জন আন্তজার্তিক শীর্ষস্থানীয় কার্ডিওলজিস্ট। তারা প্রত্যেকে তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে একজন দিকপাল। তাদের মধ্যে ছিলেন আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন কার্ডিয়াক সোসাইটির সভাপতি ও শীর্ষস্থানীয় কর্তা ব্যক্তিগণ।
পাঁচদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এই কনফারেন্সে প্রায় ১৫০ টা সেশনে দুই সহস্রাদিক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ও গবেষণাকর্ম উপস্থাপিত হয়। ভারতের বিভিন্ন ক্যাথল্যাব থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন হৃদরোগ ইন্টারভেনশন সরাসরি উপস্থাপিত হয়। অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে দুই খণ্ডে প্রকাশিত ‘সিএসআই কার্ডিওলজি আপডেট–২০২৩’ সহ গত এক বছরে প্রকাশিত বিভিন্ন হৃদরোগ সংক্রান্ত প্রকাশনা ও গাইড লাইনের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এতে ভারত তথা এই উপমহাদেশের হৃদরোগের বিভিন্ন বিশেষায়িত দিক ও তা মোকাবেলায় করণীয় উপস্থাপিত হয়। অনুষ্ঠানের প্রথমদিকে ভারত, বাংলাদেশ সহ ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, নেপাল, শ্রীলংকা ও অন্যান্য দেশের হার্ট ফেইলিউর রোগীদের বিভিন্ন দিক উপস্থাপিত হয়। অনুষ্ঠানের প্রথমদিনে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ভারতের এয়ার চীফ মার্শাল অরূপ রাহা। দ্বিতীয় দিনে অনুষ্ঠিত হয় সিএসআই ফেলোশীপ সমাবর্তন। হৃদরোগ চিকিৎসায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সিএসআই আজীবন সদস্যদের ১০ বছর পূর্তিতে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়। এবার বাংলাদেশ থেকে ব্যক্তিগতভাবে আমি এই ফেলোশিপ গ্রহণ করি। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে সমাবর্তন বক্তৃতা দেন ভারতের বিশিষ্ট আইটি বিজ্ঞানী, গবেষক, প্রফেসর অজয় কুমার রায়। তিনি তার বক্তৃতায় ডিজিটাল প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে হৃদরোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিভিন্ন দিক ও তার ভবিষ্যৎ তুলে ধরেন। উল্লেখ্য ২০২১ সালে সিএসআই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বায়ুমান নির্দেশিকায় স্বাক্ষর করে। ২০২২ সালে তা প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিয়ে একটা এপস এর মাধ্যমে বায়ুদুষণ বিষয়ে জন সচেতনতা সৃষ্টি কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং বায়ুমান (এ কিউ আই) গণনা করে তার উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
হৃদরোগ সনাক্ত করা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মেশিন লার্নিং এর মাধ্যমে ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফী, সিটিস্ক্যান, এমআরআই ও অন্যান্য ইমেজিং ডাটা থেকে নির্ভুল ভাবে হৃদরোগ নিরূপণ করা যায়। মেশিন লার্নিং এর অংশ হিসাবে কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ডিপ লার্নিং পদ্ধতিতে হৃদরোগ সনাক্ত সহজ হয়। এতে রোগীর হৃদস্পন্দন ও শ্বাসক্রিয়াকে ব্যবহার করে মুহূর্তের মধ্যে তার জ্ঞান হারানোর আশঙ্কা নিরূপণ করা হয়। এতে হৃদরোগজনিত হঠাৎ মৃত্যু সনাক্ত করে তা ঠেকানো সম্ভব হয়। এই হঠাৎ হৃৎক্রিয়া বন্ধজনিত মৃত্যুই বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ। বিনা মেঘে বজা্রঘাতের মতো ঘটে যাওয়া এই মৃত্যুই শতকরা ৫০ ভাগ হৃদরোগঘটিত মৃত্যুর জন্য দায়ী। স্মার্টফোন ও বিভিন্ন ডিভাইস ব্যবহার করে তা আগাম জানা যায়। বর্তমানে স্মার্টফোনে ইসিজি ডিভাইস সংযোজন করে তা প্রেরণ পূর্বক দূরবর্তী স্থান থেকে মনিটরের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের ছন্দপতন বা অ্যারিয়মিয়া সনাক্ত করা হয় এবং ওষুধ ও ইন্টারভেনশনাল চিকিৎসায় তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
হার্ট ফেইলিউর নিয়ন্ত্রণ: তা বর্তমানে সারা বিশ্বে এক মস্তবড় স্বাস্থ্য সমস্যা। এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এই রোগের ভোগান্তি ও মৃত্যুর হার কমাতে তার ধারাবাহিক সেবা শুশ্রূষা আবশ্যক, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে সম্ভব। আক্রান্ত রোগীর ক্লিনিক্যাল তথ্য উপাত্ত ও ইমেজিং ডাটা বিশ্লেষণপূর্বক দূরবর্তীস্থানে অবস্থানরত স্বাস্থ্যকর্মী তার চিকিৎসা প্রদান করতে পারে। এতে রোগীর হাসপাতালে ভর্তির খরচ ও ঝুঁকি দুটোও কমবে। রোগীর গায়ে লাগানো ডিভাইস এর মাধ্যমে ঘরে অবস্থানরত রোগীকে দূরবর্তীস্থান থেকে মনিটরিং করা হয়। তাছাড়া হার্টফেইলিউর রোগীর জন্য প্রতিস্থাপিত উন্নত প্রযুক্তির ডিভাইস, যেমন আইসিডি, সিআরটি ইত্যাদির কার্যকারিতা মনিটর করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উপযোগী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে গায়ে পরিধানযোগ্য বিভিন্ন ডিভাইস ও অ্যাপ্স রোগীর নাড়ীর গতি, রক্তচাপ, অক্সিজেনের মাত্রা ও ইসিজি মনিটর করে। এভাবে তা আসন্ন হৃৎ সংকট এবং তা মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণ করতে পারে।
হৃদরোগের ভবিষ্যতবাণী ও প্রতিরোধ: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হৃদরোগ সৃষ্টির আগেই তার গতি প্রকৃতি সনাক্ত করে। মেশিন লার্নিং ও ডিপলার্নিং প্রক্রিয়ায় রোগীর মেডিকেল তথ্যউপাত্ত, ইমেজিং এর ফলাফল এবং জিনগত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা করা সম্ভব হয়। এতে সহজ হয় প্রতিরোধমূলক সচেতনতা।
চ্যাট্ জিপিটি: এই ভাষা মডেল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশেষ প্রয়োগ। তা যেমন বিনোদন জগতে সঙ্গীত ও গল্পতৈরী করছে, রাজনীতি অঙ্গনে বক্তৃতা প্রচার করছে, তেমনি চিকিৎসাক্ষেত্রে রোগীর উপসর্গ, ল্যাবরেটরী ডাটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইলেক্ট্রনিক ভাষা সংরক্ষণ, প্রশাসনিক কর্মকান্ডের অটোমোশন ও রোগীকে প্রশিক্ষিত করতে অবদান রাখছে। এতে স্বল্প সময়ে বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনা, গবেষণা প্রটোকল তৈরী সম্ভব হচ্ছে। তা স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যত ভিত্তি তৈরী করতে পারে।
হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। তবে কি প্রযুক্তি নির্ভর এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি মানুষের সহজাত বুদ্ধিমত্তার বিকল্প হতে যাচ্ছে? তা কি হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের স্থান দখল করবে? তা কখনও সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যতে যারা তা রপ্ত করতে অক্ষম হবে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারকারীদের তুলনায় পিছিয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। অবশ্য অন্য সব প্রযুক্তির মতো তারও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আবেগহীন এক যান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই আবেগ, অনুভূতিই মানুষকে অন্যসব সৃষ্টি থেকে আলাদা করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রামে যতক্ষণ না মানুষ কোনও পরিবর্তন আনবে ততক্ষণ সেও তার আচরণে কোনও পরিবর্তন আনবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মানবিক গুণাবলীর সমন্বয় এখনও সম্ভব হয়নি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আধুনিকতম সভ্যতার অংশ। তা মানুষকে দিয়েছে কাজের অভিনবত্ব আর বেগ। যাযাবরের বিখ্যাত উক্তির মতো, ‘আধুনিক সভ্যতা দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। আর এই আবেগের প্রয়োগে প্রয়োজন মানুষের বিবেক ও বিচার বুদ্ধি। এই দুটোর সমন্বয়েই হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে এই নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ সফল করে তুলতে পারে।
লেখক: সেক্রেটারী জেনারেল, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন, সাবেক বিভাগীয় প্রধান,
হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।