বিংশ শতাব্দীতে এসে বাংলা সাহিত্যে এমন এক নাম আবির্ভূত হয়েছিল, যিনি সাহিত্যকে করে তুলেছিলেন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। তিনি আর কেউ নন, জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তার সাহিত্য শুধু কাগজে–কলমে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা প্রবাহিত হয়েছে মানুষের হাসি, কষ্ট, ভালোবাসা ও একাকিত্বের ভেতর দিয়ে। তিনি ছিলেন একাধারে কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গীতিকার। কিন্তু সব পরিচয়ের ওপরে তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের গল্প সহজ করে বলা একজন লেখক।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কেটেছে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে অধ্যয়ন শেষে শিক্ষকতা করলেও সাহিত্যই হয়ে ওঠে তার আত্মপ্রকাশের প্রধান ক্ষেত্র। তার প্রথম উপন্যাস “নন্দিত নরকে” প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে, যা প্রকাশের পরপরই বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারা সূচিত করে। এই উপন্যাসে তিনি দেখান– সাহিত্য মানে শুধু রাজনীতি, দর্শন বা তত্ত্ব নয়। সাহিত্য হতে পারে জীবনের ক্ষুদ্রতম অনুভূতিরও প্রকাশ।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যজগতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তার বাস্তবতাবোধ। তিনি মানুষের জীবনের ছোট ছোট ঘটনার মধ্যে বিশাল অনুভূতির জগত খুঁজে পেতেন। এক মফস্বলের মেয়ের প্রেম, এক ব্যর্থ প্রেমিকের নীরবতা, পারিবারিক টানাপোড়েন কিংবা এক শিশুর সরল প্রশ্ন, এই ক্ষুদ্রতম উপাদানগুলো তার কলমে পেতো বিশাল অর্থবহ রূপ।
শঙ্খনীল কারাগার, এইসব দিনরাত্রি, অচিনপুর ইত্যাদি উপন্যাসে আমরা দেখি, তিনি কীভাবে সাধারণ মানুষকে তার লেখার নায়ক করেছেন। সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, তাদের হাসি–কান্না, সংকট ও ভালোবাসাই ছিল তার প্রধান বিষয়বস্তু।
এই সাধারণ মানুষদের জীবনের ভেতর দিয়েই তিনি সমাজ, রাজনীতি ও সময়ের প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। কোনো অতিরঞ্জন বা নাটকীয়তা ছাড়াই তিনি এমনভাবে জীবনকে ধরেছেন যে, পাঠক নিজেকে চিনে ফেলেন তার গল্পে। এ কারণেই হুমায়ূনের সাহিত্য পাঠকনির্ভর, পাঠকই তার চরিত্রের সহযাত্রী।
বাংলা গদ্যকে হুমায়ূন আহমেদ এমন এক অবস্থানে নিয়ে গেছেন যেখানে সাহিত্য আর ‘উচ্চমানের’ পাঠকদল নয়, বরং সাধারণ মানুষেরও আপন করে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। তার ভাষা ছিল অতি সহজ, সরল অথচ গভীর। তিনি জানতেন কঠিন শব্দ নয়, বরং সহজ বাক্যের ভেতর দিয়েই মানুষের হৃদয়ে পৌঁছানো যায়।
হুমায়ূনের সংলাপ ছিল জীবন্ত, মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি। তার লেখায় শব্দের চমক বা অলঙ্কারের ভিড় নেই, আছে কেবল অনুভূতির গভীরতা। উদাহরণস্বরূপ, “কোথাও কেউ নেই” উপন্যাসে বাক্যগুলো এত স্বাভাবিকভাবে সাজানো যে পাঠক মনে করে যেন পাশের ঘরের মানুষ কথা বলছে।
এই সহজতার ভেতরেই ছিল তার জাদু। সাহিত্য সমালোচকরা একে বলেন, “সাহিত্যের গণতন্ত্রীকরণ।” তিনি প্রমাণ করেছেন, সাহিত্যকে জনপ্রিয় করে তোলাও এক ধরনের শিল্প, এবং সেটি কখনোই মানহীন হয় না যদি তা হৃদয় থেকে আসে।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জগতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রহস্য ও মনস্তত্ত্বের সংমিশ্রণ। তার সৃষ্ট চরিত্র মিসির আলি বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা করেছে। মিসির আলি পেশায় মনোবিজ্ঞানী। তিনি যুক্তি, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষের অদ্ভুত অভিজ্ঞতাগুলো ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পাঠক বুঝতে পারেন সব রহস্যের সমাধান যুক্তি দিয়ে হয় না। এই দ্বন্দ্বই মিসির আলি সিরিজকে করেছে রহস্যময় ও আকর্ষণীয়।
অন্যদিকে, তার আরেক সৃষ্টি হিমু সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। হিমু যুক্তির সীমা মানে না। সে বিশ্বাস করে অন্তর্জ্ঞান, আকাশ, মেঘ ও অদ্ভুত এক জীবনদর্শনে। হলুদ পাঞ্জাবি পরে শহর ঘুরে বেড়ানো এই তরুণ একাধারে দার্শনিক, ভবঘুরে ও প্রেমিক। “হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম”, “মেঘ বলেছে যাব যাব”, “হিমুর রোমাঞ্চকর জীবন” এসব উপন্যাসে হিমু হয়ে উঠেছে এক যুগের প্রতীক, যে জীবনের প্রচলিত কাঠামো ভেঙে নতুন প্রশ্ন তোলে।
এই দুই চরিত্র, মিসির আলি ও হিমু আসলে মানুষের দুই মেরুর প্রতিচ্ছবি। একজন যুক্তির, অন্যজন অনুভূতির প্রতিনিধি। এই দ্বৈত সত্তার মধ্যেই হুমায়ূন আহমেদ দেখিয়েছেন মানুষের মনোজগতের জটিলতা।
হুমায়ূনের সাহিত্যে প্রেম এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তবে তার প্রেম কোনো অতিনাটকীয় বিষয় নয়। তার প্রেমিক–প্রেমিকারা কখনো আলাদা হয়, কখনো একত্র হয়, কিন্তু তাদের ভালোবাসা কখনো মিথ্যা হয় না। দারুচিনি দ্বীপ, তোমাদের এই নগরে, আমার আছে জল ইত্যাদি উপন্যাসে প্রেমকে তিনি জীবনের দার্শনিক অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। তার লেখায় প্রেম মানে শুধু সম্পর্ক নয়, তা এক ধরনের আত্মজিজ্ঞাসা।
প্রেমের পাশাপাশি তিনি দেখিয়েছেন পারিবারিক সম্পর্কের উষ্ণতা ও দূরত্ব। মা–ছেলে, ভাই–বোন, স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্কগুলো তার গল্পে অত্যন্ত মানবিকভাবে ফুটে ওঠে। ময়ূরাক্ষী বা বহুব্রীহি–তে আমরা দেখি, পারিবারিক সম্পর্ক কেবল রক্তের নয়, তা আবেগেরও বন্ধন।
যদিও হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য সাধারণত ব্যক্তিজীবন ও মনস্তত্ত্বকেন্দ্রিক, তবুও তিনি সমাজ ও রাজনীতির বাস্তবতা থেকে দূরে ছিলেন না। তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য দলিল। সেখানে যুদ্ধের ভয়াবহতা, ত্যাগ, বিশ্বাসঘাতকতা ও মানবিক বেদনা একসাথে ধরা পড়েছে। ১৯৭১, দেয়াল, শঙ্খনীল কারাগারসহ কিছু উপন্যাসে আমরা দেখি, সময়ের ইতিহাস তার গল্পের পটভূমি হয়ে উঠে এসেছে।
তার নাটকগুলোয় সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংকট, সামাজিক রীতি–নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও মানসিক ক্লান্তি গভীরভাবে প্রতিফলিত। অয়োময়, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, প্রভৃতি নাটক শুধু বিনোদন নয়, বরং সময়ের প্রতিচ্ছবি।
হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র, এবং তার লেখায় বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোও ছড়িয়ে আছে। শিশুদের জন্য লেখা তার বইগুলো যেমন– তারা তিনজন, পৃথিবীর বাইরে, চাঁদনীপসার গল্প, বিপদসংকেতসহ প্রভৃতি শিশুদের কল্পনাশক্তিকে জাগিয়ে তোলে। তার গল্পে শিশুরা শেখে প্রশ্ন করতে, ভাবতে, পৃথিবীকে নতুন চোখে দেখতে।
তার সায়েন্স ফিকশন গল্পগুলোতে যেমন– অনন্ত অমর বা অয়োময়–এর পর্বগুলোতে, তিনি বিজ্ঞানের সঙ্গে কল্পনার এক আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। এদিক থেকে তিনি ছিলেন বাংলা বিজ্ঞানের কল্পকাহিনীর অন্যতম পথিকৃৎ।
সত্তর ও আশির দশকে হুমায়ূন আহমেদ টেলিভিশন নাটককে নতুন প্রাণ দিয়েছেন। এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, এসব নাটক শুধু জনপ্রিয়ই হয়নি, সামাজিক বাস্তবতা ও মানুষের আবেগের বিশ্লেষণেও অনন্য।
পরে তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণেও আসেন। আগুনের পরশমণি, শ্রাবণ মেঘের দিন, দারুচিনি দ্বীপ, ঘেটুপুত্র কমলা, প্রতিটি চলচ্চিত্রে তিনি গল্প, সংলাপ, দৃশ্য ও সংগীতের অপূর্ব মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। তার চলচ্চিত্রগুলোও সাহিত্যেরই সম্প্রসারিত রূপ।
হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্যকে বাণিজ্যিক নয়, বরং মানবিক বিনোদনের রূপ দিয়েছেন। পাঠক তার বই পড়ে যেমন হাসে, তেমনি কাঁদে, ভাবনায় পড়ে, এবং নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাতে পারে। এটাই তাঁকে সময়ের চেয়ে বড় করেছে।
হুমায়ূনের সাহিত্য দর্শন মূলত মানবিকতার দর্শন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ তার আনন্দ, বেদনা, ভয় ও ভালোবাসার ভেতর দিয়েই প্রকৃত অর্থে মানুষ হয়ে ওঠে। তাই তার চরিত্রগুলো কোনো নায়কের আদলে নয়। তার চরিত্রগুলো কখনো দুর্বল, কখনো ভীত, কখনো ভুল করে। এই মানবিকতার দৃষ্টিভঙ্গিই তার সাহিত্যকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে।
পরিশেষে বলতে চাই, হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। তিনি ছিলেন এমন এক যুগের প্রতিনিধি, যেখানে মানুষ সাহিত্যকে নতুনভাবে চিনেছিল, ভালোবাসা ও জীবনের ভাষা খুঁজে পেয়েছিল গল্পের ভেতরে। তার সাহিত্য জীবনের নানান দিক সম্পর্কে শেখায়, বলা যায় জীবনের পাঠ। তিনি শিখিয়েছেন– ভালোবাসা মানে শুধু সম্পর্ক নয় বরং এক ধরনের বেঁচে থাকা। হুমায়ূন আহমেদ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও, পৃথিবীর মানুষ তাকে কখনো ভুলবে না। তিনি বেঁচে আছেন প্রতিটি গল্পে, প্রতিটি পাঠকের হৃদয়ে। তার সাহিত্য আমাদের জীবনেরই প্রতিধ্বনি।









